বাড়ি-গাড়ি-স্বর্ণ, কিছুই ছিল না সাবেক মন্ত্রী পার্থর!

ইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কয়েক দফার অভিযানে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ’বান্ধবী’ হিসেবে পরিচিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের একাধিক ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে নগদ প্রায় ৫০ কোটি রুপি। স্বর্ণ পাওয়া গেছে কয়েক শ ভরি। বিদেশি মুদ্রাও আছে। আর মিলছে একের পর বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান।

ভারতের আর্থিক দুর্নীতি তদন্তের জন্য গড়া ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এসবের কিছুই জানা যায়নি। বরং সদ্য বিদায়ী এ মন্ত্রী সর্বশেষ নির্বাচনী হলফনামায় বলেছিলেন, তাঁর নিজের বাড়ি-গাড়ি—কিছুই নেই।

তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এসব কর্মকাণ্ডের দায় আর নিতে চাইছে না পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার। যদিও দলের প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুদিন আগেও বলেছিলেন, বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু ভুলত্রুটি হয়েই থাকে। মন্ত্রী পার্থর ভুলের দায় যাতে নিজেদের ওপর না পড়ে, সে জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পার্থকে তাঁর মন্ত্রিত্ব থেকে বরখাস্ত করেন। দল থেকেও তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতাকে গ্রেপ্তার করে ইডি।
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পার্থ ছিলেন এই রাজ্যের মন্ত্রিসভার তিনটি দপ্তরের দায়িত্বে। শিল্প ও বাণিজ্য, পরিষদীয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের। গতকাল ‘দুর্নীতি ও কুকর্মের’ জন্য মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত করে মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন তিন দপ্তরের দায়িত্ব।

মমতা ঘোষণাও দিয়েছেন, শিগগিরই এ রাজ্যের মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হবে। গড়া হবে নতুন করে রাজ্য মন্ত্রিসভা। এর আগে অবশ্য মন্ত্রিসভার দুই সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও সাধন পান্ডে প্রয়াত হলেও সেই শূন্য আসনে কাউকে না এনে মন্ত্রিসভার অন্যদের মধ্যে তাঁদের দপ্তর ভাগ করে দেন।

২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার বেহালা পশ্চিম আসনের তৃণমূলের প্রার্থী হন। সে সময় নির্বাচন কমিশনে তাঁর আর্থিক অবস্থার যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে এই পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি, জমিজমা নেই। নেই কৃষিজমিও। সব মিলিয়ে তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৯০ লাখ ১৪ হাজার ৮৬৩ রুপি। এর মধ্যে নগদ রয়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৬ রুপি। এ ছাড়া তাঁর দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রয়েছে যথাক্রমে ২৪ লাখ ৮১ হাজার ও ২৩ লাখ ৩২ হাজার টাকার স্থায়ী আমানত।

পার্থ বলেছিলেন, তাঁর শুধু পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত ছোট্ট একটি বাড়ি নাকতলায় রয়েছে। এ বাড়ির নাম ’বিজয় কেতন’। দেড় কাঠা জমির ওপর তৈরি বাড়িটি। এটি ১৯৮৯ সালে তাঁর বাবা দিয়েছিলেন। তখন এ বাড়ি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ছয় লাখ রুপি। এখন এর মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ রুপি। হলফনামায় পার্থ আরও বলেছেন, তাঁর কোনো ঋণ নেই। নেই সোনা, হীরা, প্লাটিনামের কোনো অলংকার বা গয়না।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া কয়েক কোটি রুপি।
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পার্থর হলফনামায় আরও বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাঁর উপার্জন ছিল ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৭২০ রুপি। ইডির হাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পিতার প্রদত্ত নাকতলার বাসভবন বিজয় কেতন থেকে। সেখানেই ইডি হানা দিয়েছিল।

তৃণমূলের জন্ম থেকে মমতার সঙ্গে আছেন পার্থ। সবাই জানতেন, মমতার ডান হাত তিনি। সেই পার্থই ধরা পড়লেন এবার স্কুলশিক্ষক নিয়োগে (এসএসসি) দুর্নীতি করে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। ইডিই ধরিয়ে দিল পার্থর দুর্নীতিকে।
বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষক নিয়োগে এ রাজ্যের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হচ্ছিল ইডির হাতে। ইডিও তদন্ত শুরু করে পার্থর বিরুদ্ধে। হাজির হন দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার পার্থর বাড়িতে।

শুরু করেন জেরা। জেরা চলে একটানা ১৯ ঘণ্টা। পার্থ এ বাড়ি থেকেই গ্রেপ্তার হন। এর আগে ইডি পার্থর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর ‘বান্ধবী’ হিসেবে পরিচিত কলকাতার মডেল অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের টালিগঞ্জের আবাসন থেকে উদ্ধার করে নগদ ২১ কোটি ৯০ লাখ রুপি। আর একইভাবে বুধবার দিনরাত অভিযান চালিয়ে ইডি অর্পিতার উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়ার আরেকটি আবাসন থেকে উদ্ধার করে ২৭ কোটি ৯০ লাখ রুপি। সব মিলিয়ে ওই দুদিনে উদ্ধার হয় ৪৯ কোটি ৮০ লাখ রুপি।

অর্পিতার ফ্ল্যাটে মেলে বিপুল পরিমাল স্বর্ণ
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

তবে গতকাল বৃহস্পতিবার অর্পিতার আর একটি আবাসনেও তল্লাশি চালায় ইডি। এ আবাসন রয়েছে কলকাতার রাজারহাটের নিউটাউনের চিনার পার্ক এলাকায়। সেখানে কী উদ্ধার হয়েছে, তা এখনো ঘোষণা করেনি ইডি।

এই বিপুল অর্থ উদ্ধারের পর অর্পিতা জানিয়ে দেন, ওই অর্থ তাঁর নয়, এসব সাবেক মন্ত্রী পার্থর। অর্পিতা জানতেনও না, এখানে কত টাকা এভাবে রাখা হয়েছে। এদিকে উদ্ধার এই বিপুল অবৈধ অর্থের মালিক (অর্পিতার কথায়) পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখনো স্বীকার করেননি যে ওই অর্থের মালিক তিনি। তবে ইডি দাবি করেছে, ওই অর্থ পার্থর। তিনি ওই অর্থ গচ্ছিত রেখেছিলেন অর্পিতার দুটি আবাসনে।