সুনাকের সাফল্যে সরকার ও বিরোধী পক্ষে ভারতে বিতর্ক

ঋষি সুনাক
ছবি: রয়টার্স

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের আগে থেকেই ভারতে শুরু মহাবিতর্কের। ব্রিটেনে যা সম্ভবপর হলো, আজকের ভারতে তা হতে পারে কি না—এই নিয়ে বিতর্ক। সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন সরকার ও বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজও।

বিতর্কের সূত্রপাত কংগ্রেসের সাংসদ শশী থারুরের টুইট ঘিরে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৪২ বছরের সুনাক ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হতে চলেছেন—গত সোমবার তা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শশী থারুর টুইট করে বলেন, ‘এটা যদি হয় (ঋষি প্রধানমন্ত্রী), তা হলে আমাদের স্বীকার করতেই হবে ব্রিটিশরা গোটা বিশ্বে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। দৃশ্যত সংখ্যালঘু একজনকে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পদে তাঁরা বসালেন। আমরা ভারতীয়রা তাঁর এই উত্থান উদ্‌যাপন করছি। কিন্তু ভাবুন তো, এ দেশে এমনকি হতে পারবে?’

স্পষ্টতই থারুর সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের দিকেই নির্দেশ করেছিলেন। কিন্তু সরাসরি তা না লেখায় বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। যেহেতু মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। থারুরের মতো একই ঢংয়ে একই বিষয়ের অবতারণা করেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও দেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। তাঁর টুইট, ‘প্রথমে কমলা হ্যারিস, এখন ঋষি সুনাক। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জনগণ সংখ্যালঘু নাগরিকদের বুকে জড়িয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পদে তাঁদের নির্বাচিত করেছেন। আমি মনে করি, এ দেশের গরিষ্ঠতাবাদের পূজারিদের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।’

আরও পড়ুন

একই কথা অন্যভাবে উপস্থাপন করে বিতর্কে ঘৃতাহুতি দেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি। ঋষি সুনাকের নির্বাচন তুলে ধরে তিনি সিএএ-এনআরসির প্রসঙ্গ টেনে দেশের শাসকদের একহাত নেন। মেহবুবা টুইটে লেখেন, ‘প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন বলে আমরা গর্বিত। সারা দেশ যখন এই সাফল্য উদ্‌যাপন করছে, আমরা তখন সিএএ-এনআরসির মতো বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী আইনের ফাঁদে হাঁসফাঁস করছি।’

তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র যিনি কথায় কথায় বিজেপিকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন, টুইট করে ঋষিকে অভিবাদন জানিয়ে লিখেছেন, ‘ব্রিটেন আমার দ্বিতীয় প্রিয়তম দেশ। একজন ব্রিটিশ এশীয়কে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বসানোর জন্য গর্ববোধ করছি। সমাজের সব অংশের সব বিশ্বাসের মানুষদের গ্রহণে ভারত আরও সহিষ্ণু হয়ে উঠুক।’

সুনাকের সাফল্যকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু প্রশ্নে শাসক দলের এমন সমালোচনা বিজেপি মেনে নিতে পারছে না। বিশেষ করে তারা ক্ষিপ্ত মেহবুবা মুফতির টুইটে। বিজেপি নেতা রবিশংকর প্রসাদ গতকাল মঙ্গলবার পাল্টা টুইটে তাঁকে আক্রমণ করে জানতে চান, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জম্মু-কাশ্মীরে কোনো সংখ্যালঘুকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবেন কি না। প্রসাদ লেখেন, ‘মেহবুবা মুফতিজি, জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী পদে কোনো সংখ্যালঘুকে কি মেনে নেবেন? অনুগ্রহ করে জবাব দিন।’ প্রসাদ এরপর লেখেন, ‘১০ বছর মনমোহন সিং দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ পি জে আবদুল কালাম অসম্ভব দক্ষ রাষ্ট্রপতি ছিলেন।’

সামাজিক মাধ্যমেও বিষয়টি বহু চর্চিত। ভারতে মুসলমান ও শিখধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেমন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তেমনই মনমোহন সিংয়ের মতো শিখ প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। এই যুক্তির বিপ্রতীপে এটাও ঠিক যে ৭৫ বছরে কোনো মুসলমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী হননি। কোনো হিন্দু জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীও হতে পারেননি। সোনিয়া গান্ধীকে নিয়েও একসময় কংগ্রেসের একাংশে ও বিজেপিসহ বিরোধী মহলে বেজায় আপত্তি উঠেছিল।

বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত আট বছরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বও দিন দিন কমে গেছে। এক বছর আগের ছবিটি কেমন ছিল সাংবাদিক লেখক আকার প্যাটেল তা জানিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের কোনো রাজ্যে একজনও মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী নেই। ১৫টি রাজ্যে কোনো মুসলমান মন্ত্রী নেই। ১০ রাজ্যে ১ জন করে মুসলমান মন্ত্রী আছেন।

আরও পড়ুন

অধিকাংশই সংখ্যালঘু উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত। শাসক বিজেপিতে একজনও মুসলমান লোকসভা সদস্য আগে হননি, এখনো নেই।’ রাজ্যসভাতেও বিজেপি এখন মুসলমানশূন্য দল। উত্তর প্রদেশের মতো মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যে বিজেপি লোকসভা ও বিধানসভার ভোটে একজন মুসলমানকেও প্রার্থী করেনি। এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও মুসলমান সম্প্রদায় দুই মেরুর বাসিন্দা। যদিও ভোটের স্বার্থে মুসলমান সমর্থন পেতে ওই সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া পসমন্দাদের বিজেপি তোষামোদ শুরু করেছে।

শশী থারুর প্রশ্ন রেখেছেন, ভারতে কি এমন হতে পারে? তাঁর প্রশ্নের মূল নির্যাস ধরতে পেরে সাংবাদিক, লেখক ও কবি প্রীতিশ নন্দী জবাবি টুইটে বলেছেন, ‘মনে হয় না তেমনটি কখনো হবে। এটা ঠিক, দৃশ্যত এক সংখ্যালঘু দুই মেয়াদের জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন (মনমোহন সিং)। কিন্তু এখন মনে হয় তেমন আর হবে না। বাস্তবিকই সেটা অসম্ভব বলা যায়।’