উত্তরাখন্ডে ভূমিধসের আতঙ্ক, সাময়িক বন্ধ চার ধাম ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাধের চার ধাম সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কিছু অংশের কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভূমিধসের আতঙ্ক থেকে উত্তরাখন্ডের জোশিমঠের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করতে বিজেপি শাসিত এ রাজ্যের চামোলি জেলা প্রশাসন গত বৃহস্পতিবার এ নির্দেশ দিয়েছে। শুধু চার ধাম প্রকল্পই নয়, সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তপোবন–বিষ্ণুগড়ে ৫২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র তৈরির কাজও।

জোশিমঠের আতঙ্কগ্রস্ত বাসিন্দাদের যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধার করতে এ মুহূর্তে প্রশাসন সক্রিয়। নিরাপদ স্থানে তৈরি করা হচ্ছে অস্থায়ী বাসস্থান। উদ্ধারকাজে সাহায্যের জন্য হেলিকপ্টার তৈরি রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্তত এক হাজার বাড়ি, বহু রাস্তা, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি কংক্রিকেটের ‘বাফার’, এমনকি চাষের জমিতেও দেখা দিয়েছে বিরাট বিরাট ফাটল। বহু ফাটলের মধ্য থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করেছে। কোথাও বেরিয়ে এসেছে ভূগর্ভস্থ পানি। কয়েক শ পরিবার ইতিমধ্যেই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। যেকোনো স্থান যেকোনো সময়ে ধসে পড়বে এমন আতঙ্ক বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তরাখন্ডের এ গুরুত্বপূর্ণ শহরে এমন আতঙ্ক আগে দেখা যায়নি।

উন্নয়নের নামে যথেচ্ছ নির্মাণকাজ, যেখানে সেখানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুড়ঙ্গ (টানেল) তৈরির জন্য পাহাড়ের গভীরে বিস্ফারণ ঘটানো, সড়ক চওড়া করার জন্য পাহাড় ভাঙা এবং লাখ লাখ গাছ কাটার প্রতিশোধ প্রকৃতি এভাবে নিচ্ছে বলে পরিবেশবিদেরা মনে করছেন। তাঁদের অভিযোগ, বেখেয়ালি উন্নয়নের কুফল কতটা, বারবার তা বলেও কোনো লাভ হয়নি। সরকার তো বটেই, আদালতও কর্ণপাত করেনি। গোটা উত্তরাখন্ডজুড়ে এই আতঙ্ক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নতুনভাবে সামনে নিয়ে এসেছে প্রকৃতি বনাম উন্নয়নের চিরায়ত প্রশ্ন ও বিতর্ককে।

চার ধাম প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতিও জড়িয়ে ছিল প্রবলভাবে। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে যে চারটি তীর্থের মর্যাদা অনস্বীকার্য, সেগুলো হলো উত্তরাখন্ডের বদ্রিধাম, গুজরাটের দ্বারকা, ওডিশার পুরী ও তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম। সর্বভারতীয় এই চার ধামের পাশাপাশি উত্তরাখন্ডের চারটি তীর্থস্থান ‘ছোট চার ধাম’ বলে সুপরিচিত। কেদারনাথ, বদ্রিধাম, গঙ্গার উৎপত্তিস্থল গঙ্গোত্রী ও যমুনার উৎপত্তি যেখানে সেই যমুনোত্রী।

হিন্দুত্বের পালে বাতাস দেওয়ার তাগিদ ও সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তাড়নায় উত্তরাখন্ডের এই চার ধাম সড়কপথে সংযুক্ত করার এক পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেই অনুযায়ী রাস্তা চওড়া করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবেশবিদরা তো বটেই, স্থানীয় সচেতন জনতাও প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।

স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশ সচেতন আন্দোলনকর্মীরা হিমালয়ে এই ধরনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, উন্নয়নের নামে পাহাড় ভাঙা ও প্রকৃতির সামঞ্জস্য নষ্ট করা অর্থহীন ও যুক্তিহীন। যথেচ্ছ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরিরও প্রবল বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছিলেন, এখনই রাশ না টানলে প্রকৃতি একদিন ঠিক শোধ নেবে।

সরকার কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি মানেনি। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল, চীন সীমান্ত সুরক্ষিত করতে ওই এলাকার রাস্তা চওড়া করা প্রয়োজন। রাস্তা চওড়া না হলে চীন সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের ‘প্রতিরক্ষা যুক্তি’ মেনে প্রকল্পের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে কি না দেখার জন্য এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা মেনে চার ধাম প্রকল্পের অধীন রাস্তা চওড়া (চারটি গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারে এমন) করার যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন আজকের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। অন্য দুই বিচারপতি ছিলেন সূর্যকান্ত ও বিক্রম নাথ। দেশের নিরাপত্তার প্রতি ‘ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা’র অন্য কোন ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, আজকের জোশিমঠের হাল তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

প্রাকৃতির বিপর্যয়ের জন্য চামোলি থেকে জোশিমঠ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিশেষ পরিচিত। গত কয়েক দশক ধরে সেই পরিচয় পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চামোলি তুষারধস ঋষিগঙ্গা ও ধৌলাগঙ্গা নদীতে বান ডেকে এনেছিল। তাতে মারা গিয়েছিলেন দুই শতাধিক মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তপোবন–বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও। ২০১৩ সালে কেদারনাথে ভয়াবহ বন্যায় মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজারের বেশি মানুষ।

২০২২ সালের অক্টোবরেও ঘটেছিল তেমনই এক বিপর্যয়। পাহাড়ের ধসে শতাধিক নিহত ও নিখোঁজ হয়েছিলেন। শুধু ২০২১ সালেই উত্তরাখন্ডে ছোট–মাঝারি দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৩টি, যাতে প্রাণ হারান ৩ শতাধিক মানুষ, অগণিত গৃহপালিত পশু, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬ হাজার ঘরবাড়ি, নষ্ট হয় কয়েক হাজার বিঘা জমির ফসল। এত তথ্য সত্ত্বেও আদালতের নির্দেশে চার ধাম প্রকল্পের কাজ মান্যতা পেয়েছে। জোশিমঠজুড়ে আতঙ্কের পর আপাতত একাংশের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে যে তা আবার শুরু হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেননা, প্রকৃতি বনাম উন্নয়নের লড়াইয়ে সব সময় প্রকৃতির হার হয়।

হিমালয়ভিত্তিক পরিবেশসংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ‘দ্য থার্ড পোল’–এর দক্ষিণ এশীয় অধিকর্তা পরিবেশবিদ জয়দীপ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়নের নামে হিমালয়ের গভীরে যা হচ্ছে, তাতে এই ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো অসম্ভব। জোশিমঠে যা হয়েছে, অন্যত্রও বারবার তেমন ঘটবে। প্রকৃতিকে শাসন করতে গেলে প্রকৃতি এভাবেই শোধ নেয়। দুঃখের কথা, অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণে আমরা অপারগ।’ তিনি বলেন, ‘বাড়ির নিচে ভিতের তলায় ডিনামাইট ফাটালে ভিত নড়ে যাবেই।’

হিমালয় বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদ কল্যাণ রুদ্র প্রথম আলোকে বলেন, হিমালয় সর্বকনিষ্ঠ পর্বতমালা। এর অভ্যন্তরে ভূমি গঠনের কাজ ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। জোশিমঠ–বদ্রিধাম ভূমিকম্পপ্রবণ স্থান। হিমালয়ের সর্বত্র লাগামহীনভাবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হচ্ছে।

এসব যে আরও কী ধরনের বিপর্যয় ঘটাবে, কেউ কল্পনাও করতে পারছে না। তিনি বলেন, চার ধাম রাস্তা এত চওড়া করার কোনো মানেই হয় না। প্রকৃতিরও সহ্যের সীমা রয়েছে এটা ভুললে চলে না। সব কিছু সাময়িক লাভ লোকসানের নিরিখে চালানো ঠিক নয়। পরিবেশবিদেরা সহমত যে জোশিমঠের ব্যাপক ফাটল ও আতঙ্ক আগামী দিনের অশনিসংকেত।