ভোটের হার সামান্য ভালো হলেও বিজেপির চিন্তা যাচ্ছে না

তেলেঙ্গানা রাজ্যে নির্বাচনী সমাবেশে কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে হঠাৎ আদানি-আম্বানির নাম উচ্চারণ করলেন মোদি। আজ ৮ মেছবি: এএনআই

প্রথম দুই দফার তুলনায় তৃতীয় দফার ভোটের হার সামান্য ভালো হলেও বিজেপির চিন্তা যাচ্ছে না। তারা ভেবে পাচ্ছে না, খোদ প্রধানমন্ত্রী বারবার বলা সত্ত্বেও মানুষ কেন ভোটের দিন কেন্দ্রমুখী হতে চাইছেন না। তারা বিশেষভাবে চিন্তিত হিন্দি বলয়ের সেসব রাজ্য নিয়ে, যেখানে ১০ বছর ধরে মানুষের নিঃশর্ত সমর্থন ঢালাওভাবে পেয়ে এসেছে।

এ পরিস্থিতিতে আজ বুধবার নরেন্দ্র মোদির মুখে আচমকাই শোনা গেল আদানি-আম্বানির নাম। দুই শিল্পপতির নাম করে তিনি বলেন, ভোট শুরু হতেই কংগ্রেস এই দুটি নাম মুখে আনা বন্ধ করেছে। তবে কি কংগ্রেস তাদের কাছ থেকে ট্রাকভর্তি অর্থ পেয়েছে? শাহজাদা কি বলবেন, কত টাকা তাঁরা পেয়েছেন?

প্রথম দুই দফায় প্রাথমিকভাবে ভোট পড়েছিল ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। পরে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাবে তার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে। ভোটের হার বেড়ে যায় প্রায় ৬ শতাংশ! তা নিয়ে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সরব হলেও নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা শোনাতে পারেনি। ফলে বিরোধীদের মনে একধরনের সন্দেহ বাসা বাঁধছে। বিজেপিকে জেতানোর জন্য নির্বাচন কমিশন কোনো খেলা খেলছে কি না, সেই প্রশ্নের উদয় হচ্ছে।

ইভিএম নিয়ে বিরোধীরা প্রথম থেকেই সন্দিহান। সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। কিন্তু তা রায়বিরোধীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এখন আচমকা ভোটের হার এতখানি বেড়ে যাওয়ায় সেই সন্দেহ নতুনভাবে দানা বাঁধছে।

ভোটের হার বাড়লে বা কমলে কার সুবিধা, কার অসুবিধা, তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। সাধারণভাবে মনে হয়, হাওয়া থাকলে ভোটের হার বেড়ে যায়। সেই হাওয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হলে তাতে শাসকের লাভ হয়, যেমন হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, ১৯৯৯ কিংবা নরেন্দ্র মোদির বদৌলতে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে।

আবার বিরুদ্ধে গেলে ক্ষতি হয় শাসক দলের। যেমন কংগ্রেসকে ভুগতে হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এবার আশ্চর্যজনকভাবে তেমন কোনো হাওয়া কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোটের মতো কোনো ইস্যুও মাথাচাড়া দেয়নি। তাই তিন দফার ভোট হয়ে গেল স্বাভাবিক চিরায়ত ছন্দে, হাওয়াহীন।

ঘটনা হলো, প্রথম দুই দফার মতো তৃতীয় দফার ভোটের পরও বিরোধীরা যথেষ্ট উৎফুল্ল। তাদের পাশাপাশি বিজেপি কিছুটা নিষ্প্রভ, চিন্তিতও। চিন্তার প্রথম কারণ বিরোধীরা উল্লসিত বলে। দ্বিতীয় কারণ, প্রধানমন্ত্রী বারবার বলা সত্ত্বেও তাদের খাসতালুকে ভোটারদের মধ্যে অনীহা। অথচ হাওয়া তুলতে মোদি চেষ্টার কসুর করেননি। সরাসরি হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সামনে টেনে এনেছেন। ধর্মের নামে ভোট চেয়েছেন।

ভোটের প্রচারে মোদি বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে তফসিল জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসরদের সংরক্ষণ কোটা তুলে দিয়ে মুসলমানদের সংরক্ষণ দেবে। এক ধাপ এগিয়ে কল্পনায় ভর দিয়ে ডাহা মিথ্যা বলে শুনিয়েছেন। কংগ্রেসের ইশতেহারে বলা হয়েছে, তারা এক্সরে মেশিন নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে সাধারণের কষ্টার্জিত সম্পদ কেড়ে নেবে। তারপর বিলিয়ে দেবে ‘যারা শুধু গাদা গাদা সন্তানের জন্ম দেয়’, তাদের মধ্যে, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে।

নরেন্দ্র মোদি ভেবেছিলেন, এই বিভাজনী রাজনীতির প্রচার হিন্দুদের ব্যাপকভাবে বুথমুখী করে তুলবে। ভোটের হার বাড়বে। সেই আশায় গত রোববার অযোধ্যায় রোড শোও করলেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও গতকাল মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশের ১০ আসনে ভোটের হার ৫৭ শতাংশের কাছে ঘুরঘুর করল! বিজেপি নেতারাই বলাবলি করছেন, উত্তর প্রদেশ, বিহার, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ ঘরবন্দী থাকছেন।

কিন্তু কেন ওই আচরণ, ভোট দিতে কেন এমন অনীহা, তার ব্যাখ্যা বিজেপিতে নেই। বিরোধীরা মনে করছেন, এটাই তাঁদের আশা–ভরসার কারণ। তাঁদের ধারণা, যাঁর নামে বিজেপি ভোট চাইছে, সেই মোদি তাঁর জৌলুশ হারিয়েছেন। ম্যাজিক আর কাজ করছে না। ফলে তিন দফার ভোটের পর বিরোধীদের ধারণা, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়তো হবে। কিন্তু দলটির ৪০০ পার তো দূরের কথা, শরিকদের নিয়ে ৩০০–এর কাছাকাছি পৌঁছানোও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

নরেন্দ্র মোদি অবশ্য হাল ছাড়েননি। বিজেপিতে তিনিই এক থেকে এক শ। তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে দলের সবাই। প্রচারের সব আকর্ষণও তিনিই। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মতো করে নিরলসভাবে এবং তা করতে গিয়ে তিনি আঁকড়ে ধরছেন হিন্দুত্ববাদকেই। তিনি বুঝেছেন, কাজের ফিরিস্তি দেখিয়ে লাভ নেই। ভালোভাবে জিততে হলে ভরসা ওই ‘মুসলমান–জুজু’।

মোদির প্রচারের কৌশল বলে দিচ্ছে, কংগ্রেসকে মুসলমানদের দল হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে হিন্দুদের সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। ‘চার শ পার’ স্লোগান নিয়ে তাই নতুন এক ব্যাখ্যাও তিনি শুনিয়েছেন গতকাল মঙ্গলবার। তিনি বলেন, চার শতাধিক আসন না পেলে কংগ্রেস অযোধ্যায় নতুন তৈরি রামমন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দেবে। ঠিক যেভাবে তারা তালা লাগিয়েছিল বাবরি মসজিদে। আইন করে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও বদলে দেবে। ঠিক যেভাবে শাহ বানো মামলায় রাজীব গান্ধী করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নতুন করে কংগ্রেসকে আক্রমণ করছেন, মুসলমানদের দল বলে প্রতিপন্নের চেষ্টা চালাচ্ছেন, ‘কংগ্রেসের হাত, পাকিস্তান কে সাথ’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। এতে এটাই সম্ভবত বোঝা যাচ্ছে, জয় নিয়ে তিনি এখনো হয়তো পুরোপুরি নিশ্চিত নন।

আজ বুধবার তেলেঙ্গানায় গিয়ে মোদি ভোটযুদ্ধে এই প্রথম আদানি-আম্বানিকে টেনে আনলেন। গত পাঁচ বছরে যে আদানি বা আম্বানির নাম তিনি উচ্চারণ পর্যন্ত করেননি, আজ তা করলেন। মেলে ধরলেন সম্ভাব্য দুর্নীতির এক কাহিনি।

মোদি বলেন, ‘এত দিন ধরে যাঁরা উঠতে–বসতে আদানি-আম্বানিকে গালি দিয়ে এসেছেন, ভোট শুরু হতেই তাঁরা চুপ। তাঁদের মুখে আদানি নেই, আম্বানি নেই। কেন নেই? শাহজাদা (রাহুল গান্ধী) কি জানাবেন, আম্বানি–আদানির কাছ থেকে কত মাল (অর্থ) পেয়েছেন? ট্রাক, টেম্পোবোঝাই কত টাকা কংগ্রেসের কাছে গেছে? কী সওদা হয়েছে, যাতে রাতারাতি কংগ্রেস আম্বানি-আদানিদের গালি দেওয়া বন্ধ করেছে?’

বিরোধী ব্যাখ্যা, প্রধানমন্ত্রীর আচরণ বন্যায় খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা। এই আচরণই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর দল খুব একটা স্বস্তিতে নেই।