পাঞ্জাবে হঠাৎ খালিস্তান আন্দোলন, স্বঘোষিত নেতাকে ধরতে অভিযান
পাঞ্জাবের স্বঘোষিত খালিস্তানি নেতা ২৯ বছর বয়সী অমৃতপাল সিং এখনো অধরা। পাঞ্জাব পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে অভিযানের তৃতীয় দিন আজ সোমবারও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও অমৃতপালের সংগঠন ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’, যার বাংলা অর্থ ‘পাঞ্জাবের উত্তরাধিকারী’, তার দ্বিতীয় পদাধিকারী বলে পরিচিত এবং অমৃতপালের কাকা হরজিৎ সিংসহ প্রথম সারির মোট ১১২ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার এ অভিযান শুরু হয়।
অমৃতপালের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় চারজনকে গতকাল রোববার বিশেষ বিমানে আসামের ডিব্রুগড়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে কড়া নিরাপত্তায় তাঁদের কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। গোটা ঘটনাপ্রবাহের তদন্তভার তুলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) হাতে।
অমৃতপাল যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য সীমান্তবর্তী পাঞ্জাবে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাংশের ধারণা, নতুনভাবে খালিস্তানি আন্দোলন সক্রিয় করে তুলতে দেশে–বিদেশে পাকিস্তান সক্রিয়। সেই কাজে ভারতবিরোধী বিভিন্ন শক্তিও মদদ জোগাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, যে সরকার সর্বদা জাতীয়তাবাদের জাহির করে চলেছে, অমৃতপালের মাথাচাড়া দেওয়া তাদের কি গোচরে ছিল না? থাকলে কেনই–বা কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর উপস্থিতি দেশের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করেনি? এত আটঘাট বেঁধে শুরু করা অভিযানই–বা তাঁকে ধরতে ব্যর্থ কেন?
অমৃতপালকে ধরতে গোটা পাঞ্জাব পুলিশ কয়েক দিন ধরে সক্রিয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী করে তিনি এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি, তা বিস্ময়ের! পুলিশ বলছে, বারবার পোশাক ও গাড়ি বদলে অমৃতপাল পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গতকাল গাড়ি বদলের পর তাঁর কাকা হরজিৎ সিং ও তাঁদের গাড়িচালককে পুলিশ ধরে ফেলে। পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলায় অমৃতপালের পরিত্যক্ত গাড়ি থেকে অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। পুলিশের সন্দেহ, অভিযানের খবর কোনোভাবে তিনি আগেভাগেই পেয়ে যাচ্ছেন। অমৃতপালকে ধরতে পাঞ্জাব পুলিশ আরও কয়েকটি দল গঠন করছে।
পাঞ্জাবের রাজনীতিতে অমৃতপাল সিংয়ের উত্থান ধুমকেতুর মতো। দুই বছর আগেও যিনি ছিলেন অজ্ঞাতপরিচয়, ২০১২ সাল থেকে যিনি দুবাইয়ে গাড়ি চালাতেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি, আচমকাই তিনি গত বছরের শেষে দেশে এসে কীভাবে খালিস্তানের স্বঘোষিত নেতা হয়ে গেলেন এবং হাজার হাজার সশস্ত্র অনুগামী তৈরি হয়ে গেল, তা বিস্ময়ের! এতটাই অজ্ঞাতকূলশীল ছিলেন যে ঠিক কবে তিনি পাঞ্জাবে ফিরেছেন, তা নিজে ঘোষণার আগে গোয়েন্দারা জানতেও পারেনি! ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবের বহু ঘটনার সাক্ষী শিখদের কাছে পবিত্র শহর হিসেবে গণ্য আনন্দপুর সাহিবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। তাঁর চার দিন পর খালিস্তানের প্রবক্তা জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের গ্রাম মোগা জেলার রোডে গ্রামে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’র শীর্ষ পদে তাঁর অভিষেক।
‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পাঞ্জাবি সিনেমার অভিনেতা ও সমাজকর্মী দীপ সিং সিধু। প্রধানত পাঞ্জাবের যুব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের জন্য তিনি ওই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। কৃষি বিলের প্রতিবাদে কৃষকদের দিল্লি অভিযানের সময় লাল কেল্লায় শিখ ধর্মের পতাকা ‘নিশান সাহিব’ তুলে প্রচারের আলোয় চলে এসেছিলেন দীপ সিধু। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাঞ্জাবে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। দীপের মৃত্যুতে সংগঠনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, অমৃতপাল তা পূরণই শুধু করেননি, নতুন করে খালিস্তানি আন্দোলনের সূচনাও ঘটিয়েছেন।
আজকের পাঞ্জাবের রাজনীতিতে তাই হঠাৎই অমৃতপাল প্রাসঙ্গিক। খালিস্তান গঠনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে পাঞ্জাবের ‘দাসত্ব ঘোচানোর’ কথা তিনি বলেছেন। ভারতীয় ‘ঔপনিবেশিকতার বন্ধন মুক্তির’ কথা বলেছেন। ধর্মান্তর রুখতে খ্রিষ্টান পাদরিদের পাঞ্জাবের গ্রামে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা বলেছেন। সশস্ত্র সংগ্রামে উৎসাহিত করতে নানা কথা বলেছেন। স্পষ্টভাবে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, পাঞ্জাবের দাসত্ব মুক্তির জন্য ভিন্দ্রানওয়ালেই তাঁর আদর্শ। তাঁর দেখানো পথেই তিনি হাঁটবেন।
পাঞ্জাবের কংগ্রেস, বিজেপি, অকালি দলের পাশাপাশি রাজ্যের শাসক দল আম আদমি পার্টি এবং অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকার কেউই এতকাল অমৃতপালের উত্থান ও খালিস্তানি আন্দোলনের মাথাচাড়া দেওয়ার বিষয়টির কেন আঁচ পায়নি, সেই প্রশ্ন উঠছে। কোনো মহলেই যদিও গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে কীভাবে কোনো একজন এত অনুগামী জুটিয়ে ফেলেন, অস্ত্র আমদানি করতে পারেন, সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তরও কোনো মহলে নেই।
অমৃতপালের ইশারায় বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি শক্তি রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে বোঝা যায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী লাভপ্রীত সিং তুফানকে দাঙ্গা ও অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল অমৃতসরের আজনালা থানা। তাঁর মুক্তির দাবিতে অমৃতপালের নির্দেশে প্রায় এক হাজার সশস্ত্র সমর্থক থানা ঘেরাও করে এবং লাভপ্রীতকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। সেই হামলায় বেশ কিছু পুলিশ আহত হয়েছিলেন। তার পরেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মানের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শুরু হয় অমৃতপালকে ধরার অভিযান।
সংগত কারণে প্রশ্ন উঠছে, যে সরকার সর্বদা জাতীয়তাবাদের জাহির করে চলেছে, অমৃতপালের মাথাচাড়া দেওয়া তাদের কি গোচরে ছিল না? থাকলে কেনই–বা কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর উপস্থিতি দেশের পক্ষে ক্ষতিকর মনে করেনি? এত আটঘাট বেঁধে শুরু করা অভিযানই–বা তাঁকে ধরতে ব্যর্থ কেন? যে সরকার গত কয়েক মাস ধরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইংল্যান্ডে খালিস্তানপন্থীদের কাজকর্মে রাশ টানতে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তারা দেশে অমৃতপালের উপস্থিতিতে কেন উদাসীন ছিল এত মাস?
প্রশ্নগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের দক্ষতা ও সদিচ্ছাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। পাঞ্জাবের তরুণ সম্প্রদায়ের হতাশা, রাজ্যজুড়ে মাদকের রমরমা বাণিজ্য বন্ধে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাও এই অবসরে প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে নতুনভাবে চর্চিত হচ্ছে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া খালিস্তানি আন্দোলন।