ভারতে নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের ইস্তফা নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা, নেই উত্তর

নির্বাচন কমিশনার অরুন গোয়েলফাইল ছবি: এএনআই

ভারত সরকারের সংস্কৃতিসচিবের পদ থেকে অরুণ গোয়েলের স্বেচ্ছায় অবসর যতটা চমক সৃষ্টি করেছিল, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জন্ম দিয়েছিল রাজনৈতিক বিতর্কের। সেসব ছাপিয়ে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ভারতের নির্বাচন কমিশনারের পদ হুট করে তিনি কেন ছেড়ে দিলেন, তা সৃষ্টি করেছে এক বিস্ময়কর জিজ্ঞাসার। গতকাল শনিবার তাঁর পদত্যাগের পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা কাটতে চললেও সেই জিজ্ঞাসার উত্তর কারও কাছে নেই।

কী করবে কেন্দ্রীয় সরকার, তা–ও অজানা। কারণ, একটা দিন কেটে গেলেও সরকার বা শাসকদলের কেউ তাঁর পদত্যাগ নিয়ে একটি মন্তব্যও করেননি। অথচ সময়মতো লোকসভার ভোট করতে গেলে তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহও বাকি নেই।

আরও পড়ুন

ভারতের নির্বাচন কমিশনের মোট সদস্য তিনজন। একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও দুজন নির্বাচন কমিশনার (ইসি)। সিইসি হলেন রাজীব কুমার। আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি অবসর নেবেন। এক মাস আগে ফেব্রুয়ারিতে মেয়াদপূর্তির ফলে ইসির পদ থেকে অবসর নিয়েছেন অনুপচন্দ্র পান্ডে। তাঁর পদে এখনো কেউ নিযুক্ত হননি। শনিবার সন্ধ্যায় আচমকা অরুণ গোয়েল পদত্যাগ করায় তিন সদস্যের কমিশন এখন একজনের। ভোটের আগে শূন্য পদ পূরণ করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে তড়িঘড়ি উদ্যোগী হতে হবে। হাতে সময় একেবারেই নেই।

সেই নিযুক্তিও হবে অভিনব। এতকাল নির্বাচন কমিশনারের নিযুক্তি করতেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে অংশগ্রহণের দাবি নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন অব্যাহত। সেই অমীমাংসিত রেষারেষির দরুন প্রধান বিচারপতিকে ওই দায়িত্ব থেকে সরকার অব্যাহতি দিয়েছে। নতুন আইনে নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যকে নিয়োগ করবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কোনো এক শীর্ষ সদস্য। নতুন আইনে নতুন নিযুক্তি এবারই প্রথম হবে।

এসব বিষয় ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে অরুণ গোয়েলের ইস্তফা, তাঁর বিতর্কিত নিযুক্তির মতোই যা নানা রকম আগ্রহের সঞ্চার করেছে।

পাঞ্জাব ক্যাডারের এই আইএএস অফিসার শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ক্ষমতায় এসে মোদি তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সংস্কৃতিসচিবের। উদ্দেশ্য ছিল নেহরু-গান্ধী জমানায় ‘অবহেলিত’ স্বাধীনতাসংগ্রামীদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা। ইতিহাস নতুন করে লেখা। তারই অঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম শুরু। স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ উদ্‌যাপনের দায়িত্বও পড়েছিল গোয়েলের ওপর। সেই দায়িত্ব পালনের পর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ভারী শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব করেন। সেই পদ থেকেই আচমকা স্বেচ্ছায় অবসর এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন হিসেবে নিযুক্তি।

সেই নিযুক্তি চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছিল। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর অরুণ গোয়েলের অবসর নেওয়ার কথা ছিল। ১৮ নভেম্বর তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে নিযুক্ত করা হয় নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম জোসেফ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পদটি মে মাস থেকে খালি। কী এমন ঘটল যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নিয়োগ দিতে হলো? ভাবনাচিন্তারও সময় নিলেন না?’

একই প্রশ্ন ছিল বিচারপতি অজয় রাস্তোগিরও। অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানিকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘যেদিন আবেদন জমা পড়ল, সেদিনই গৃহীত হলো। সেদিনেই তাঁর নাম প্রস্তাব করা হলো, সেদিনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিল এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নতুন নিযুক্তি! যাচাই পর্যন্ত হলো না?’ অ্যাটর্নি জেনারেলের উত্তর ছিল, ‘২০১৫ সালের পর বহু ক্ষেত্রেই দ্রুত নিযুক্তি হয়েছে। দ্রুত নিযুক্তি কর্মোদ্যোগী সরকারের লক্ষণ। প্রশংসনীয়।’

সুপ্রিম কোর্টে সেই মামলা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। ২০২৭ সাল পর্যন্ত অরুণ গোয়েলের কাজের মেয়াদ ছিল। বর্তমান সিইসির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তারপর অরুণ গোয়েলেরই সিইসি হওয়ার কথা ছিল।

গোয়েল তাঁর ইস্তফাপত্রে ব্যক্তিগত কারণের উল্লেখ করেছেন। তাঁর পদত্যাগের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব জল্পনার আকারে উঠে এসেছে। যেমন মতবিরোধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্রর দাবি, দিল্লির নেতাদের সঙ্গে তীব্র মতবিরোধ পদত্যাগের কারণ। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে যোগ দিতে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে কোনো অজ্ঞাত কারণে বৈঠক ছেড়ে মাঝপথেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মহুয়ার দাবি, দিল্লির নেতাদের আজ্ঞাবহ হতে তিনি রাজি হননি। মতবিরোধ চলছিল।

দ্বিতীয় তত্ত্ব নির্বাচনে দাঁড়ানো। কারও কারও ধারণা, লোকসভা ভোটে অরুণ গোয়েলকে দাঁড় করানো হতে পারে। এই জল্পনা জোরালো হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির পদ থেকে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পদত্যাগ করেই বিজেপিতে যোগ দেওয়ায়। তৃতীয় তত্ত্ব, সরকারের সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে, যা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছিল না।

কারণ যা–ই হোক, সরকারের সামনে উপায় এখন দুটো। এক, সিইসির ওপর নির্ভর করে লোকসভা নির্বাচন পরিচালনা করা, দুই, দ্রুত বৈঠক ডেকে ইসি নিয়োগ। সে জন্য পাঁচজনের নাম চূড়ান্ত করতে হবে। সার্চ কমিটি গড়তে হবে। তিন সদস্যের কমিটির বৈঠক ডাকতে হবে। এত দ্রুত তা সম্ভব কি?

অরুণ গোয়েলের নিযুক্তি বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তাঁর পদত্যাগ বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। সেই সঙ্গে জল্পনারও।