যৌতুক দেবে না, তাই ছেলেরা শুধু তাঁকে দেখেই চলে যায়

বিয়ে
প্রতীকী ছবি

ভারতে ১৯৬১ সাল থেকে যৌতুক অবৈধ। তারপরও এখনো চিত্র এতটুকু বদলায়নি। এখনো কনের পরিবার বিয়েতে বরের পরিবারকে নগদ অর্থ, পোশাক ও গয়না দেবে—এমনটাই আশা করে থাকে ছেলেপক্ষ।

মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী ভূপালের এক নারী শিক্ষক যৌতুক নামের এই ‘সামাজিক ব্যাধি’ দূর করতে বিয়ের আসরে পুলিশ মোতায়েন ও অভিযান চালানোর আরজি জানিয়ে আবেদন করেছেন।

যৌতুক না দেওয়ার কারণে বেশ কয়েকজন পাত্রের পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত গুঞ্জন তিওয়ারি (ছদ্মনাম) বিবিসিকে বলেন, নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এ আবেদন করেছেন।

সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে গত ফেব্রুয়ারিতে। একজন পাত্র তাঁর পরিবারসহ গুঞ্জনকে দেখতে তাঁদের বাড়িতে আসেন। তাঁর মা–বাবা অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে গুঞ্জন চা ও খাবার নিয়ে বসার ঘরে যান। ওই মুহূর্তটাকে গুঞ্জন ‘বিরক্তিকর’ বলে মন্তব্য করেন। বিবিসিকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘সবাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।’

অতিথিরা এলে কেমন করে তাঁদের সামনে যেতে হবে, কী করতে হবে—এসব নিয়ে আগে থেকে গুঞ্জনকে বেশ নসিহত করা হয়। তাঁর মায়ের মনে হয়, সবুজ রংটা মেয়েকে মানায়। তাই সেদিন তাঁকে সবুজ রঙের পোশাক পরানো হয়। বলা হয়, অতিথিদের সামনে যাতে না হাসে। কারণ, তাহলে ছেলেপক্ষ তাঁর অসমান দাঁতগুলো দেখে ফেলবে।

এই মহড়ার সঙ্গে গুঞ্জন পরিচিত। গত কয়েক বছরে এভাবে তিনি অন্তত×ছয়বার পাত্রপক্ষের সামনে হাজির হয়েছেন। তারা যেসব প্রশ্ন করে, সেগুলোও গুঞ্জন জানেন। প্রথমে পড়াশোনা কত দূর, কী কাজ করেন, রান্না করতে জানেন কি না—এসব প্রশ্ন করা হয়।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যথেষ্ট যৌতুক না দেওয়ায় ৩৫ হাজার ৪৯৩ জন নববধূর মৃত্যু হয়েছে, যা গড়ে প্রতিদিন ২০ জন।

গুঞ্জন ফেব্রুয়ারির ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, বসার ঘরে আসার আগে তাঁর কানে আসে তাঁর মা–বাবা পাত্রের বাবার কাছে জানতে চাইছেন, তাঁরা যৌতুক হিসেবে কী চান। তাঁরা ৫০-৬০ লাখ রুপি চাইছিলেন। পরে আবার পাত্রের বাবা মজা করে বলেন, ‘আপনার মেয়ে যদি সুন্দর হয়, তাহলে কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হবে।’ এরপর তাঁকে দেখার পর আর ছাড় প্রসঙ্গে এল না। পাত্রপক্ষ তাঁর অসমান দাঁত ও কপালে থাকা আঁচিল নিয়ে কথা বলছিল।

চা পর্ব শেষে পাত্র-পাত্রীকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য পাঁচ মিনিট দেওয়া হয়। তখন গুঞ্জন পাত্রকে জানিয়ে দেন, যৌতুক দিয়ে তিনি বিয়ে করবেন না। গুঞ্জন বলেন, পাত্র তাঁর সঙ্গে একমত হন। তিনিও বলেন, এটি একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’। এ সময় তাঁর মনে হয়েছে, এখন পর্যন্ত তিনি যতগুলো পাত্রের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁদের মধ্যে এই ব্যক্তি আলাদা। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেখান থেকে ‘না’ জবাব এল।

গুঞ্জন বলেন, ‘আমার মা এর জন্য আমাকে দুষতে থাকেন। বলেন, ‘আমার এই যৌতুকবিরোধী মনোভাবের কারণে এমনটা হচ্ছে। তিনি রাগে আমার সঙ্গে দুই সপ্তাহ কথা বলেননি।’

গত ছয় বছরে গুঞ্জনের বাবা ১০০-১৫০ জন সুযোগ্য পাত্রের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং দুই ডজনের বেশি পাত্রের সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানান গুঞ্জন। প্রায় সব কটিই যৌতুকের জন্য ‘না’ হয়েছে।

গণিতে স্নাতকোত্তর গুঞ্জন বলেন, এভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে তিনি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘যৌক্তিকভাবে বিচার করলে আমি দেখি আমার কোনো ঘাটতি নেই। সমস্যা হলো যৌতুক। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি মা–বাবার জন্য দায় হয়ে গেছি।’

৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে যৌতুক দেওয়া–নেওয়া বেআইনি। অথচ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটিতে ৯০ শতাংশ বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এর আর্থিক পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি ডলার।

ভারতে মেয়ের জন্মের পর থেকে মা–বাবার মাথায় বিয়ের চিন্তা ঢুকে যায়। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অভিভাবকদের প্রচুর ঋণ করতে হয়। অথবা জমি বা বাড়ি বিক্রি করে যৌতুকের চাহিদা মেটাতে হয়। যদিও এটা নিশ্চিত নয়, এই যৌতুক মেয়ের বিবাহিত জীবন সুখী করবে কি না।

জাতীয় অপরাধ রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যথেষ্ট যৌতুক না দেওয়ায় নির্যাতনে ৩৫ হাজার ৪৯৩ নববধূর মৃত্যু হয়েছে, যা গড়ে প্রতিদিন ২০ জন।

যৌতুকবিরোধী কর্মীরা বলেন, যৌতুকের অন্যতম একটি কারণ লিঙ্গবৈষম্য। জাতিসংঘের হিসাবে, ভারতে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ কন্যা ভ্রূণকে গর্ভপাত করা হয়। কারণ, পরিবারগুলোর ভয় থাকে, মেয়ে হলে বিয়ের সময় প্রচুর খরচ করতে হবে।

ভূপালের পুলিশপ্রধান হরিনারায়ণ চারি মিশ্রার বরাবর গুঞ্জন আবেদনটি করেন। সেখানে তিনি বলেন, একমাত্র সমাধান হলো বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে অভিযান চালানো এবং যারা যৌতুক দেবে ও নেবে, তাদের গ্রেপ্তার করা। তিনি মনে করেন, শাস্তির ভয় এই নিষ্ঠুর প্রচলিত ধারা বন্ধে সহায়তা করবে। গত সপ্তাহে তিনি হরিনারায়ণ চারির সঙ্গে দেখা করে এই লড়াইয়ে তাঁর পাশে থাকার অনুরোধ জানান।

যৌতুকের অভিশাপ তখনই মোকাবিলা করা সম্ভব, যখন এই তরুণ প্রজন্ম যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করবে। যখন তারা যৌতুক দিতে বা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে।
কবিতা শ্রীবাস্তব, নারী অধিকারকর্মী

গুঞ্জন বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁরা এর শেষ দেখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি সব থানায় বলে দিয়েছেন, কোনো নারী সহায়তা চাইলে উপযুক্ত সহায়তা করতে হবে।

তবে হরিনারায়ণ এ–ও বলেছেন, পুলিশের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তারা সব জায়গায় যেতে পারে না। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনে এই বিষয়ে সবার আরও সচেতনতা দরকার।

নারী অধিকারকর্মী কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, ‘পুলিশ অবশ্যই সহায়তা করতে পারে। কিন্তু যৌতুককে সামাল দেওয়া জটিল বিষয়। ভারত কোনো পুলিশি রাষ্ট্র নয়, কিন্তু এখানে যৌতুক নিষিদ্ধ করে আইন আছে। আমাদের উচিত এ আইনের আরও সদ্ব্যবহার করা।’

বাস্তবতা তুলে ধরে কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, লোভী শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক সময় শুধু একবার যৌতুক নিয়ে খুশি হয় না। তারা বারবার চাইতেই থাকে। কারণ, এভাবে খুব সহজেই ধনী হওয়া যায়। এমনও অনেক উদাহরণ আছে, যৌতুকের জন্য সারা জীবন নারী শ্বশুরবাড়িতে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এমনকি চাহিদা মেটাতে না পারায় বাবার বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে যৌতুক দেওয়া–নেওয়া বেআইনি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটিতে ৯০ শতাংশ বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এর আর্থিক পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি ডলার।

কবিতা বলেন, যৌতুকের অভিশাপ তখনই মোকাবিলা সম্ভব, যখন এই তরুণ প্রজন্ম যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করবে। যখন তারা যৌতুক দিতে বা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে।

গুঞ্জন বলেন, তিনি বিয়ে করতে চান। কারণ, পুরো জীবন একা কাটানো সম্ভন নয়। তবে তিনি যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবেন না।

কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, গুঞ্জনের পরিবার ততই মরিয়া হয়ে উঠছে। গুঞ্জন বলেন, পাশের রাজ্যে তাঁর দাদাবাড়ি। সেখানে ২৫ বছরের মেয়েকে বিয়ের বাজারে বুড়ি বলে মনে করা হয়। তাঁর বাবা প্রতিদিন পত্রিকায় পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেখেন। আত্মীয়স্বজনকে বলেন চোখ–কান খোলা রাখতে। এমনকি তাঁদের যে গোত্র, সেই গোত্রের হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপ আছে। সেখানে তাঁর বাবা যুক্ত হয়েছেন। সেখানে অনেকেই পাত্র-পাত্রীর জীবনবৃত্তান্ত পোস্ট করে।

গুঞ্জন বলেন, ‘অনেকেই খুব জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজন চায়। এতে ৫০ লাখ রুপি বা তারও বেশি খরচ হয়। কিন্তু আমার বাবার এর অর্ধেক খরচ করার মতো সামর্থ্য আছে। আমার বাবা বলেছেন, আমার জন্য পাত্র খুঁজছেন, ছয় বছর হয়েছে। আরও ৬০ বছর দেখলেও তিনি যৌতুক ছাড়া বিয়ের জন্য ছেলে পাবেন না।