শেষ দফায় কলকাতা দখলের লড়াই

রেখা পাত্র, তাপস রায়, অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ, সুজন চক্রবর্তী, মালা রায়, দেবশ্রী চৌধুরী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়রা হালিম, সৌগত রায় ও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ছবি: সংগৃহীত

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম ও শেষ দফার ভোট গ্রহণ শনিবার শেষ হচ্ছে। এ দফায় ভারতের সাত রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫৭ আসনে ভোট হবে। পশ্চিমবঙ্গে ভোট হবে ৯ আসনে।

ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৩টি আসনের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৯ আসনের মধ্যে কলকাতা শহরে রয়েছে দুটি। এ দুটি আসনের ভোট গ্রহণ নিয়ে কলকাতার রাজনীতির পারদ চূড়ায় উঠেছে। এ দফার ভোট অনেকটা কলকাতা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

কলকাতা উত্তর ও কলকাতা দক্ষিণ—এই দুটি আসন একটা সময় পর্যন্ত কংগ্রেসের দখলে ছিল। মাঝে অবশ্য এই আসনগুলো হাতছাড়া হয়েছে। বাম দলও পেয়েছে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এই আসন দুটি চলে যায় তৃণমূলের হাতে।

শনিবার কলকাতার এই দুটি আসন ছাড়াও লড়াই হবে রাজ্যের আরও সাত আসনে। এই সাত আসন কলকাতা শহরের আশপাশেই অবস্থিত।

ফলে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ছয় দফার নির্বাচনের চেয়ে শেষ দফায় জোর লড়াই হবে নয়টি আসনে। আগের ছয় দফার নির্বাচনে কোনো দফায় একসঙ্গে নয়টি আসনে লড়াই হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের নয়টি আসন হলো কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, যাদবপুর, দমদম, বারাসাত, বসিরহাট, ডায়মন্ড হারবার, জয়নগর ও মথুরাপুর। ৯ আসনে লড়ছেন ১২৪ জন প্রার্থী।

রাজ্যের শেষ দফার ভোটে রয়েছেন একঝাঁক তারকা প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজন চক্রবর্তী, তাপস রায়, মালা রায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য অন্যতম। আরও রয়েছেন তরুণ প্রজন্মের বাম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য ও প্রতীক-উর-রহমান।

ভোট হতে যাওয়া নয়টি আসনের সব কটিতে ২০১৯ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিলেন তৃণমূলের প্রার্থীরা। গতবার যাঁরা জিতেছিলেন, এবার তাঁদের তিনজনকে মনোনয়ন দেয়নি তৃণমূল। মনোনয়নবঞ্চিতরা হলেন বসিরহাট কেন্দ্রে অভিনেত্রী নুসরাত জাহান, মথুরাপুর কেন্দ্রে চৌধুরী মোহন জাটুয়া ও যাদবপুর কেন্দ্রে অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। পুরোনো ছয়জনের সঙ্গে এবার যোগ হওয়া নতুন তিনজন হলেন বসিরহাটের হাজি নুরুল ইসলাম, মথুরাপুরের বাপী হালদার ও যাদবপুরে অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ।

কলকাতা উত্তর আসনে লড়ছেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির তাপস রায় এবং কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য।

বিজেপির তাপস রায় বরাহনগর আসন থেকে তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে কলকাতার উত্তর আসনে বিজেপি থেকে মনোনয়ন পান। এ আসনে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যেই মূল লড়াই হবে।

কলকাতা দক্ষিণ আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন বিদায়ী সংসদ সদস্য মালা রায়, বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী, বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়েছেন সায়রা শাহ হালিম। সায়রা পশ্চিমবঙ্গ বিধাসভার টানা ২৯ বছরের সাবেক স্পিকার হাসিম আবদুল হালিমের পুত্রবধূ। পেশায় তিনি সমাজসেবী। তাঁর স্বামী ফুয়াদ হাসান একজন নামী চিকিৎসক। সায়রা ভারতের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন শাহর ভাতিজি। তাঁর আসনে লড়াই হবে ত্রিমুখী। তৃণমূল-বিজেপি-বাম দলের মধ্যে।

দমদম কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বিদায়ী সংসদ সদস্য সৌগত রায়। বিজেপির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শীলভদ্র দত্ত। আর বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী। এখানেও তৃণমূল-বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থীদের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে।

যাদবপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ, বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ও বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। এখানে ত্রিমুখী লড়াই হবে।

ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে লড়ছেন বিদায়ী সংসদ সদস্য ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির অভিজিৎ দাস (ববি) ও বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএমের তরুণ নেতা প্রতীক-উর-রহমান। এখানে লড়াই হবে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। তবে জয়ের সম্ভাবনা তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

বারাসাত কেন্দ্রে এবারও প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলের বিদায়ী সংসদ সদস্য চিকিৎসক কাকলি ঘোষ দস্তিদার, বিজেপির স্বপন মজুমদার ও বাম-কংগ্রেস জোটের ফরোয়ার্ড ব্লক প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। এখানে তৃণমূল, বিজেপি ও বাম প্রার্থীর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে।

বসিরহাট কেন্দ্রে লড়ছেন তৃণমূলের হাজি নুরুল ইসলাম। তিনি নতুন প্রার্থী। আর বিজেপির হয়ে লড়ছেন সন্দেশখালি আন্দোলনের নারীনেত্রী রেখা পাত্র, বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী ও সাবেক সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দার। এই আসনে ত্রিমুখী লড়াই হবে। বিজেপির প্রার্থী রেখা পাত্র বেশ তেজ দেখাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জয়নগরে লড়ছেন তৃণমূলের বিদায়ী সংসদ সদস্য প্রতিমা মণ্ডল, বিজেপির নতুন প্রার্থী অশোক কান্ডারি ও বাম-কংগ্রেস জোটের আরএসপি দলের প্রার্থী সমরেন্দ্র নাথ মণ্ডল। এখানে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে লড়াই হবে।

আর মথুরাপুর আসনে লড়ছেন তৃণমূলের নতুন প্রার্থী বাপী হালদার, বিজেপির অশোক পুরকাইত ও বাম-কংগ্রেস জোটের সিপিএম প্রার্থী শরৎ চন্দ্র হালদার। এখানেও মূল লড়াইটা হবে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে।

এই ৯ আসনের মধ্যে বিজেপির লক্ষ্য অন্তত দুটি আসন ছিনিয়ে নেওয়া। বিজেপি মনে করে, মমতার পাহাড়সমান দুর্নীতিতে রাজ্যবাসী সন্তুষ্ট নন। তাঁরা কল্পনা করতে পারেননি, সততার প্রতীক মমতা এভাবে পাহাড়সমান দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বেন।

তাঁরা বুঝে গেছেন, মমতাকে ভোট দেওয়া মানে তৃণমূলের দুর্নীতিকে আরও প্রশ্রয় দেওয়া। তাই মানুষ এবার তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজেপির দিকেই ঝুঁকেছেন।

বাম-কংগ্রেস জোট মনে করছে, তৃণমূল ও বিজেপির দুর্নীতি এবং ধর্মান্ধতার কারণে মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে গেছেন। তাই এবার পশ্চিমবঙ্গে লড়াই হচ্ছে ত্রিমুখী। বাম-কংগ্রেস জোটের বিশ্বাস, তারা রাজ্যে এবার অন্তত দুটি আসনে জিতবে।

শনিবার সপ্তম দফার ভোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচন শেষ হচ্ছে। এখন সবাই তাকিয়ে আছে ৪ জুনের দিকে। ওই দিন ফলাফল প্রকাশ হবে। ওই দিনই ফয়সালা হবে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে কারা জিতছেন, ভারতের শাসনই–বা কোন দলের হাতে থাকছে।