পান্নুন হত্যাচেষ্টার কথা যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, স্বীকার করল ভারত
প্রথম অভিযোগ জানিয়েছিল কানাডা। তাদের দেশে শিখ নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার পেছনে ভারতের হাত থাকার সন্দেহের কথা বলেছিলেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এবার একইভাবে তাদের দেশের এক শিখ নাগরিককে হত্যার ষড়যন্ত্র ফাঁস করল যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ, ওই ষড়যন্ত্রে ভারতের ‘হাত’ ছিল।
বিষয়টি তারা সম্প্রতি দুই দেশের টু প্লাস টু আলোচনায় উত্থাপন করেছিল বলেও হোয়াইট হাউস জানিয়েছে।
ওই বৈঠকে বিষয়টি যে আলোচিত হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে তখন কোনো মন্তব্য করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা নিজে থেকে কিছু জানাননি। কিন্তু এখন বিষয়টি বিদেশি সংবাদপত্র প্রকাশের পর গত বুধবার রাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা স্বীকার করেছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে লিখিতভাবে জানান, ওই আলোচনায় সংগঠিত অপরাধী চক্র, আগ্নেয়াস্ত্রের কারবারি, সন্ত্রাসবাদী ও অন্যদের সম্পর্ক নিয়ে কিছু তথ্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল। দুই দেশের পক্ষেই সেই তথ্যাদি উদ্বেগজনক। দুই দেশই ওই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অরিন্দম বাগচি বলেছেন, উপযুক্ত বিভাগগুলো ওই সব তথ্য খতিয়ে দেখছে।
যুক্তরাষ্ট্র যাঁকে হত্যার চক্রান্ত ফাঁস করেছে, তাঁর নাম গুরপতবন্ত সিং পান্নুন। চল্লিশোর্ধ এই শিখ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর জেলার বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আইনজীবী পেশায় যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তিনি কানাডার নাগরিক। কানাডার খালিস্তানপন্থী নাগরিকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি হাজির থাকেন। ২০০৭ সালে সেই দেশে ‘শিখস ফর জাস্টিস’ (এসএফজে) নামের একটি সংগঠন তিনি গড়ে তোলেন, যেটিকে ভারত সরকার ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ওই সংগঠন ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের জন্য স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র গড়তে চায়। পান্নুনকেও ভারত সরকার ২০২০ সালে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
গুরপতবন্ত সিং পান্নুন সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের পতাকাবাহী উড়োজাহাজ এয়ার ইন্ডিয়ায় সফর না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশে জারি এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ১৯ নভেম্বরের পর (ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন ও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল) তাঁরা যেন এয়ার ইন্ডিয়ায় সফর না করেন। কারণ, তাতে প্রাণ সংশয় হতে পারে। ওই বার্তা জানাজানির পর পান্নুন ভারতের এনআইএর তদন্তের আওতায় চলে এসেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে পান্নুনকে হত্যার ছক বানচাল করেছে—এ খবর প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’(এফটি) পত্রিকায়। খবরটি প্রকাশিত হলো নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে কানাডার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর বিবৃতির দুই মাস পর। সেই সময় ভারত ওই অভিযোগ অস্বীকার করে যাবতীয় তথ্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্র ফাঁসের খবরটি এবার ভারত সেভাবে অস্বীকার করেনি।
বরং বিবৃতিতে স্বীকার করা হয়, দুই দেশের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু বৈঠকে পান্নুনের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, ভারত যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে, সে কথাও বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, হত্যা ষড়যন্ত্র ফাঁসের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে। এই পাঁচ দেশই গোয়েন্দা তথ্যাদি আদান–প্রদান সম্পর্কিত ‘ফাইভ আইস’ জোটের সঙ্গী। তাদের সবার ধারণা, নিজ্জর হত্যা ও পান্নুন হত্যা চক্রান্তের মধ্যে ‘আচরণগত সাজুয্য’ রয়েছে।
চলতি বছরের ১৮ জুন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে হরদীপ সিং নিজ্জর নিহত হন। সেই মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর ওয়াশিংটন পান্নুন হত্যা চক্রান্ত নিয়ে ভারতকে জানিয়েছে বলে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। ওই জানাজানির পর চক্রান্তকারীরা তাদের পরিকল্পনা বাতিল করে নাকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তা বানচাল করে দেয়, সে বিষয়ে ওই পত্রিকা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করেনি।
ওই প্রতিবেদনে সূত্রের বরাতে এ কথাও বলা হয়েছে, কূটনৈতিক স্তরে বিষয়টি জানানোর পরও নিউইয়র্ক ডিস্ট্রিক্ট আদালতে সিলবন্ধ খামে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। এখন বিচার বিভাগ সিলবন্ধ খাম খুলে অভিযোগটি প্রকাশ্যে আনবে নাকি নিজ্জর হত্যায় কানাডার তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, সেটি পরিষ্কার নয়। প্রতিবেদনে এ তথ্যও দেওয়া হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি নাকি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছেন। এতে মামলাটি জটিল হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও এফবিআই কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র জানিয়েছে, সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, এসব বিষয়ে সহযোগীদের সঙ্গে কী আলোচনা হয়, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে মতামত দেয় না। তবে তারা এ কথাও জানিয়েছে, তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা সবার আগে।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা চক্রান্ত বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক করেছিল কি না, সে বিষয়ে পান্নুন কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন।
তিনি শুধু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ভারতীয় এজেন্টের কাছ থেকে তাঁর প্রাণ সংশয় নিয়ে যা কিছু বলার যুক্তরাষ্ট্রই বলবে। এই বিপদ তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য এক চ্যালেঞ্জ। বাইডেন প্রশাসন সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় দক্ষ বলে তাঁর বিশ্বাস।
কানাডার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ভারতীয় কূটনীতির জন্য বড় একটা ধাক্কা। গণতন্ত্রী ভারতের ভাবমূর্তিও উপর্যপুরি এই জাতীয় অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ।