ঝাড়খন্ডের নতুন মুখ্যমন্ত্রী কি সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবেন

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন চম্পাই সরেনছবি: এএনআই

প্রায় ২৪ ঘণ্টা টানাপোড়েনের পর আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঝাড়খন্ডের রাজ্যপাল সি পি রাধাকৃষ্ণন রাজ্যের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সরেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে রাজ্যপাল সরকার গঠন করতে চম্পাই সরেনকে অনুরোধ করলেও নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেননি বলে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) তরফে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী চম্পাই সরেনের সঙ্গে ৮১ সদস্যের ঝাড়খন্ড বিধানসভায় ৪৭ এমএলএ সমর্থন-সংবলিত চিঠি রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এভাবে তিনি আরও কিছুদিন রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবেন।

ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেনকে গতকাল বুধবার রাতে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেপ্তার করেছে। তিনি পদত্যাগ করেছেন। তাঁর দল জেএমএম, কংগ্রেস ও অন্যান্য দল মিলিয়ে ক্ষমতাসীন জোটের কাছে ৪৭ বিধায়ক রয়েছেন। রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করলেন। এখন চম্পাই সরেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখে সরকার টিকিয়ে রাখতে পারেন কি না, সেটাই দেখার।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সরকার টিকিয়ে রাখাটা একটা সমস্যা বলে মনে করেন জেএমএমের এক বিধায়ক। ওই বিধায়ক প্রথম আলোকে আজ বৃহস্পতিবার বলেন, জোট সরকারে জেএমএমের ২৮ ও কংগ্রেসের ১৭ এমএলএ আছে। কংগ্রেসের এই এমএলএদের মধ্যে মাত্র সাতজনকে ভাঙাতে পারলেই সরকার পড়ে যাবে।

আগামীকাল রাজ্যে আসছেন রাহুল গান্ধী। তিনি তিন-চার দিন থাকবেন। তিনি রাজ্য ছাড়ার পর কংগ্রেসের এমএলএরা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএকে সমর্থন দেবেন না, তার কী নিশ্চয়তা আছে? এমন হলে ইন্ডিয়া জোটের সরকারের পতন হবে।

চম্পাই সরেনের চ্যালেঞ্জ

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রক্রিয়ায় বিজেপি ঝাড়খন্ডে জেএমএম ও কংগ্রেসের জোট সরকার ফেলার চেষ্টা করেছিল। তখন সফল হয়নি; কারণ, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন বিধায়কদের সবাইকে ছত্তিশগড়ে নিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রেখেছিলেন। বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে হেমন্ত তদন্তকারী সংস্থা ইডির হেফাজতে। চম্পাই সরেনের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আগামী সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত সরকার টিকিয়ে রাখা।

এ কাজে এই আদিবাসী নেতা অভ্যস্ত নন ঠিকই। তবে তাঁর অন্য অনেক সুবিধা রয়েছে। ৬৮ বছর বয়সী চম্পাই সরেনের প্রাথমিক সুবিধা হচ্ছে, তিনি ঝাড়খন্ডের প্রভাবশালী সরেন পরিবারের সদস্য নন। তিনি ১৯৭০-এর দশকে ঝাড়খন্ড আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে রাজনীতিতে এসেছেন। ঝাড়খন্ড আন্দোলনের কারণে ২০০০ সালে বিহার থেকে আলাদা হয়ে ঝাড়খন্ড পৃথক আদিবাসী রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠেছে। জেএমএমের প্রতিষ্ঠাতা, হেমন্ত সরেনের বাবা ও ভারতের জনজাতি সম্প্রদায়ের নেতা শিবু সরেনের হাত ধরেই চম্পাই সরেনের রাজনীতিতে আসা।

দক্ষিণ ঝাড়খন্ডের সিংভূম অঞ্চলে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চম্পাই। এ কথা আদিবাসী সম্প্রদায় ভোলেনি। এ কারণে হেমন্ত সরেন প্রথমে তাঁর স্ত্রী কল্পনাকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণার চেষ্টা করেও দল এবং জোট শরিক কংগ্রেসের চাপে পিছিয়ে যান। ফলে নিঃসন্দেহে ঝাড়খন্ডে এই মুহূর্তে বিজেপিকে রুখে সরকার বাঁচাতে চম্পাই সরেন উপযুক্ত নেতা। এ ছাড়া এই প্রবীণ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, চম্পাই প্রতিরোধপন্থী নেতা, যিনি দীর্ঘ সময় আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি তিনি ঝাড়খন্ডের শিল্প-লবিরও পছন্দের লোক। খনিজ শিল্পসমৃদ্ধ শিল্পপতিদের একাংশ বিশ্বাস করেন, তিনি অন্য প্রতিরোধপন্থী নেতাদের মতো কট্টর নন, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, খনিজ সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে রাজ্যের উন্নয়নের গুরুত্ব তিনি বোঝেন।

এ ছাড়া চম্পাইয়ের যথেষ্ট প্রশাসনিক দক্ষতা রয়েছে। তিনি দুই দশক ধরে সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা ও হেমন্তের মন্ত্রিসভায় কাজ করেছেন। দক্ষিণ ঝাড়খন্ডে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সশস্ত্র মাওবাদীদের আংশিক প্রভাব রয়েছে। সেখানে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পাশাপাশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে পরপর ছয়বার নির্বাচনে জিতেছেন তিনি।

এ কারণেই হেমন্তের গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়খন্ডের নাগরিক সমাজের একাংশের বক্তব্য, চম্পাই বুঝতে পেরেছিলেন, তীব্র প্রতিবাদ রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। অরাজকতাকে কারণ দেখিয়ে বিজেপি ঝাড়খন্ডে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারে। সেই কারণেই প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণ করেছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। তাই আশা করা হচ্ছে, তিনি জোটের ৪৭ বিধায়ককে ধরে রাখতে পারবেন।

তবে চম্পাই সরেনের চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়। তাঁর নেতৃত্বের একটা বড় চ্যালেঞ্জ আসছে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার ভেতর থেকেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সরেন পরিবারের ভেতর থেকেই। হেমন্ত সরেনের আত্মীয় সীতা সরেন তিনবারের বিধায়ক।

তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা আছে। সেই জায়গা থেকেই তিনি জেএমএমের কিছু বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে হেমন্তের স্ত্রী কল্পনার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া আটকে দিয়েছেন। আগামী দিনে বিজেপির সমর্থনে সীতা যে কংগ্রেসের ৭ বিধায়ককে নিজের দিকে টেনে সরকার ভাঙার চেষ্টা করবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

স্বাভাবিকভাবেই এই সরকারে পতনে বিজেপি মদদ দেবে। কারণ, রাজ্যে বিজেপির ভোট জেএমএম ও কংগ্রেসের যৌথ ভোটের চেয়ে বেশি, ৩৩ শতাংশ। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএর মোট আসনও কম নয়। তাদের মোট আসন ৩২। অর্থাৎ আর ১০ বিধায়ককে নিজেদের দিকে টানতে পারলেই ৮১ সদস্যের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবে বিজেপি। সেটা সীতা সরেন বা বিজেপির নেতা অর্জুন মুন্ডার নেতৃত্বে হবে কি না, তা আর কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

রাম মন্দির উদ্বোধনের পর যে বিজেপিপন্থী হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তার জেরে বিহারে জোট সরকার নিজেদের ক্ষমতায় রাখতে পারেনি। জোটের সরকার বিহারের পার্শ্ববর্তী রাজ্যেও থাকবে কি না, তা আগামী সপ্তাহের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে।