ভারত পাকিস্তানে হামলা চালালে কী হবে
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। পাকিস্তানে ভারত হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা করছে ইসলামাবাদ। শেষ পর্যন্ত যদি যুদ্ধ বেধেও যায়, তাহলে কে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বা পরিস্থিতি অন্য কোনো দিকে মোড় নিতে পারে কি না, তা নিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনে লিখেছেন সাংবাদিক এজাজ হায়দার। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো।
পাকিস্তানকে ঘিরে ভারতের পদক্ষেপগুলো সাধারণত ঘটে থাকে পরিচিত একটি ছকে। প্রথমে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরে হামলা হয়। পাকিস্তানের ওপর এর দায় চাপিয়ে দেয় নয়াদিল্লি।
এরপর ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যুদ্ধের দামামা বাজানো শুরু করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশটির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের। সেখানেই তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জয় ছিনিয়ে আনেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির উত্থান এবং সামাজিক মাধ্যমের কারণে এই উন্মাদনা এখন তুঙ্গে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর পরিস্থিতি আবারও একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবারও ভারত থেকে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সামান্য কয়েকজন, যাঁরা তাড়াহুড়া করে নেওয়া কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক, তাঁরাও ভয়াবহ যুদ্ধ না বাধিয়ে কীভাবে পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়া যায়, সে কথা ভাবছেন।
একটি বিষয় খোলাসা করা যাক। ভারত যদি পাকিস্তানের ওপর সীমিত আকারে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা কী করতে পারে। এখানে একটি বিষয় হলো সীমিত হামলা যে শেষ পর্যন্ত সীমিতই থাকবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর অর্থ এই নয় যে ভারতের হিসাবে ভুল হবে না। অনেক সময় ভুল হিসাব থেকেই যুদ্ধ শুরু হতে দেখা গেছে।
ধরে নেওয়া যাক, পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ভারত। এমনকি তা দিলও। ওই শাস্তি কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তা নেই। তবে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় এই যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে ওই শাস্তি সীমিত হবে। আরেকটু বড় পরিসরে ভাবলে এমনটা মনে করা যায় যে এক পর্যায়ে গিয়ে পাকিস্তান সিদ্ধান্ত নিল তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না। এর ফলে কি ‘যুদ্ধে’ ভারতের জয় হবে? উত্তরটা হবে—হ্যাঁ, যদি তারা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়। আর সফল না হলে, উত্তরটা হবে ‘না’।
যদি পাকিস্তানকে শাস্তি দেওয়ার পর ভারত দেশটিকে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত না রাখতে পারে? ধরা যাক এসব পদক্ষেপ ভারতের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে নয়াদিল্লি। তাহলে যে কাল্পনিক চিত্রপট তৈরি করা যায়, তাতে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে ভারত।
হিসাব জটিল করবে পারমাণবিক অস্ত্র
পাকিস্তানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ভারতের যে হিসাব–নিকাশ, তা আরও জটিল করে তুলবে ইসলামাবাদের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র। এর কারণ এটা নয় যে পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা প্রথমে বা সংঘাতের শুরুর দিকে কাজে লাগাতে পারে। বরং কারণ এটি যে দেশটির এই সক্ষমতা রয়েছে এবং হামলাকারীদের তা বিবেচনায় নিয়েই সামনে এগোতে হবে।
২০০১–০২ সালের সংকটের পর থেকেই অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে একটি নীতি অনুসরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। পারমাণবিক হামলা এড়িয়ে কীভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়েও স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এ থেকে ‘সীমিত যুদ্ধের’ একটি ধারণা সামনে এসেছে। এই ধরনের যুদ্ধ এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেন সর্বাত্মক পারমাণবিক হামলা শুরু না হয়।
সীমিত যুদ্ধ দুই ধরনের হতে পারে। এক ধরনের যুদ্ধে দুটি পরাশক্তি সরাসরি মুখোমুখি হয় না। তৃতীয় পক্ষগুলোর মধ্যে এই যুদ্ধ হয়, যেমনটা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এরই মধ্যে ঘটেছে। আরেকটি যুদ্ধ হলো পূর্ণমাত্রায় সংঘাতে না জড়িয়ে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলা। এতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত আকারে ব্যবহার করে দুই পক্ষ। এমন যুদ্ধ হলেও উভয় পক্ষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্যাসপার ওয়াইনবার্গার ‘প্রাউড প্রফেট’ ছদ্মনামে একটি অতি-গোপনীয় ‘যুদ্ধ মহড়ার’ আয়োজন করেছিলেন। তাতে সীমিত পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের তত্ত্বগুলো যাচাই–বাছাই করা হয়েছিল। ‘প্রাউড প্রফেট’ মহড়ার পর যুদ্ধের দ্বিতীয় ধারণাটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৬ সালে ওই মহড়া–সংক্রান্ত নথিগুলো প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সংঘাতে আধিপত্য
তবে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলার পরিকল্পনাও করছে না ভারত। তারা সীমিত আকারে গতানুগতিক হামলা চালাতে চায়। একই সঙ্গে হয়তো তারা এমনভাবে এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে চায় যেন পাকিস্তান পারমাণবিক হামলা করার পর্যায়ে না পৌঁছায়।
এমনকি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ও ব্রিটিশসহ পশ্চিমা কৌশলবিদেরা এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে এটা করা সম্ভব। এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে পারবে ভারত, সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে দেশটি এবং সংঘাতে নিজেদের আধিপত্যও ধরে রাখতে পারবে। আর এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে নয়াদিল্লির সমস্যার সমাধান হবে।
ভারতের এই সুযোগ রয়েছে যে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমিত সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। কারণ, প্রচলিত যুদ্ধ সক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে ভারত এমন হামলা চালানোর পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য যথেষ্ট কূটনৈতিক সক্ষমতা দেশটির রয়েছে।
আর এই হামলায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিশোধ নেওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে। কারণ, এ জন্য দেশটিকে বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামরিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে পাকিস্তান। ফলে সংঘাত বৃদ্ধি পাক, তা চাইবে না তারা। আর পাকিস্তান সংঘাত বৃদ্ধির পথে না এগোলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের আধিপত্য থাকবে।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে সীমিত যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সীমিত পরিসরে না–ও থাকতে পারে। দুই পক্ষই রক্ত ঝরাতে ঝরাতে আরও সংঘাতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শুধু আত্মসম্মান নয়, বরং প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধের জন্য তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া সংঘাত থামানোর জন্য প্রস্তুত না–ও থাকতে পারে তারা। আর সংঘাতে দুই পক্ষই যখন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন কোনো একটি পক্ষ যে পরিকল্পনা নিয়ে সংঘাত শুরু করে, তা ভেস্তে যেতে পারে।