ভারতে সামাজিক মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কারা ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে

  • ভারতে মুসলমানদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে

  • ইসরায়েলে হামাসের হামলার কথা উল্লেখ ভারতে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে

  • বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রী মোদি মুসলমানদের ব্যাপারে বৈষম্যের অভিযোগ অস্বীকার করছেন

  • ঘৃণামূলক বক্তব্য ও ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর ভারতে একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে বলা হয়, হামাসের হামলায় ১৭ জন ভারতীয় নিহত হয়েছেন। সেখানে নিহত ব্যক্তিদের তালিকাও দেওয়া হয়। এতে ভারতে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। পরে দেখা গেল, এই তালিকা ভুয়া।

পরের কয়েক সপ্তাহ ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের সংঘাত ঘিরে ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে অসংখ্য বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন তথ্য যাচাইকারী ও গবেষকদের নানা দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, সংখ্যালঘু মুসলমানদের লক্ষ্য বানিয়ে এসব ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে।

এসব বেশির ভাগ বার্তায় হিন্দুদের সতর্ক করে বলা হচ্ছে, আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জয়ী না হলে মুসলমানদের দিক থেকে তাঁদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

ফেসবুক
রয়টার্স

ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের নিরপেক্ষ তথ্য যাচাই–বাছাইকারী ভারত নায়েক বলেন, ‘প্রতিটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার উল্লেখ করে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, মুসলমানরা হচ্ছে শয়তান। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’

ভুয়া তথ্য ও ঘৃণ্য ভাষণ যাচাইকারী নায়েক বলেন, ‘যদি কোনো চলমান ঘটনা থাকে, তাহলে পুরো ঘটনার ভিডিও ও ছবি সামনে নিয়ে আসা হয় আর বলা হয়, হিন্দুদের নিরাপদ থাকতে হলে বিজেপিকে ভোট দিন।’

চিন্তক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অ্যান্টি–ডিফেশন লিগ জানায়, গত ৭ অক্টোবরের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও এক্সে (সাবেক টুইটার) ইসলামবিদ্বেষী ও ইহুদিবিদ্বেষী বক্তব্য ব্যাপক হারে বেড়েছে।

তথ্য যাচাই–বাছাইকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪০ কোটি জনসংখ্যা–অধ্যুষিত ভারতে ১৪ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আগামী বছরের মে মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ও নভেম্বরে চলমান বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন ঘিরে মুসলমানদের লক্ষ্য করে ভুয়া তথ্য ও ঘৃণামূলক বক্তব্য ব্যাপক হারে বাড়ছে।

ইউটিউব
রয়টার্স

কাতারের হামাদ বিন খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক ওয়েন জোনস বলেন, সংঘাত, নির্বাচনে এ ধরনের বয়ান ছড়ানো হয়ে থাকে। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে এ ধরনের সংঘাতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভুয়া তথ্য বিষয় নিয়ে পড়ানো এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, রাষ্ট্রের খেলোয়াড়েরা এ ধরনের বিভাজনমূলক বক্তব্য ও চাঞ্চল্যকর ভুয়া তথ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।

বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র টম ভেদাক্কানের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিজেপি এবং সরকার কোনো সম্প্রদায় বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যকে উৎসাহিত করে না।

গত জুনে হোয়াইট হাউস সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ভারতে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই।

ধর্মীয় বিবাদ

এক্স
রয়টার্স

ভারতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গত এক দশকে বিজেপির শাসনামলে দলের ও মিত্রদের নেতাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা বলছে, নেতাদের এসব বক্তব্য সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে।

হ্যাশটাগ #করোনাজিহাদ ও #লাভজিহাদ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাইরাল হয়েছে। এসব হ্যাশট্যাগে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছে। আবার জোরপূর্বক হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করে বিয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে।

আবার হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শিশুকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়। এতে ভয়াবহ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছিল।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি তৃতীয় দফায় জয়ী হতে পারে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক এমন একটি সংগঠন হিন্দুত্ব ওয়াচ। তারা বলছে,  গবেষকেরা দেখেছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে মুসলমানবিরোধী ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন গড়ে একটির বেশি এমন ঘটনা ঘটেছে।

ফ্যাক্ট চেকিং সংগঠন বুম লাইভ দেখিয়েছে, গত মে মাসে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। ওই রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল। বুমের উপসম্পাদক কারেন রেবেলো বলেন, মুসলমানদের লক্ষ্য করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তাদেরকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মালিক মেটা বলছে, ভারতে তারা আরও ফ্যাক্ট চেকার নিয়োগ দিয়েছে। তৃতীয় পক্ষ দিয়ে বিশ্বব্যাপী মেটা তথ্য যাচাই–বাছাই করে থাকে।

মেটার এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক কৌশল নিয়ে থাকি। আমাদের দল সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং আধেয় শনাক্ত ও সরিয়ে নেওয়ার কাজে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভুয়া তথ্য যাতে ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকে।’

সরকারের যত অনুরোধ

ভারতে জনসংখ্যার বিরাট একটা অংশ তরুণ। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিশাল বাজার রয়েছে এ দেশে। এখানে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ ফেসবুক এবং ৫০ কোটি মানুষ ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে।

ফলে আধেয় নিয়ে প্রায়ই ভারত সরকারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মুখোমুখি অবস্থান দেখা যায়।

মোদি সরকার নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা তুলে ধরে ২০২০ সালে সংক্ষিপ্ত ভিডিওর অ্যাপ টিকটক নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ কঠোর করে। ক্ষতিকর আধেয় থাকলে তা দ্রুত সরিয়ে নেওয়া এবং তথ্যের উৎস শনাক্ত করার দাবিও তোলে সরকার।

২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ভারত সরকারের কাছ থেকে মেটার কাছে ৬৪ হাজার আধেয় সরানোর অনুরোধ এসেছে।

ইনস্টাগ্রাম
রয়টার্স

চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারির মধ্যে গুগলের ইউটিউব ভারতে ২০ লাখের বেশি ভিডিও মুছে দিয়েছিল। এই সংখ্যা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের সহযোগী পরিচালক জয়শ্রী বাজোরিয়া বলেন, সরকার সামাজিক মাধ্যমের যেসব পোস্ট বা আধেয় সরানোর অনুরোধ করে, তার বেশির ভাগই ভিন্নমতাবলম্বী, মানবাধিকারকর্মী ও মুসলমান কর্মীদের দেওয়া। এসব আধেয় বিজেপি ও তার মিত্রদের দেওয়া আধেয়ের মতো ক্ষতিকর নয়।

বাজোরিয়া বলেন, বিজেপি নেতারা বা বিজেপি সমর্থকেরা মুসলমানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে যেসব ঘৃণামূলক বক্তব্য দেন, সে জন্য তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। অথচ তাঁদের বক্তব্য সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো জবাব দেয়নি।
ফেসবুকের হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সেস হজেন ২০১৯ সালে অভ্যন্তরণী নথিপত্র ফাঁস করার পর দেখা যায়, ভারতসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে ঘৃণামূলক বক্তব্য পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমটিকে। মেটা তখন নিরপেক্ষভাবে মানবাধিকারের প্রভাব মূল্যায়নে সম্মত হয়েছিল।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বান সত্ত্বেও মেটা পূর্ণ প্রতিবেদন আর প্রকাশ করেনি। মেটার মুখপাত্র বলেন, কোনো ধর্ম, দেশ ও জাতিগোষ্ঠী বা সামাজিক শ্রেণির বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যের ব্যাপারে ‘মেটার সুস্পষ্ট নীতি’ রয়েছে।

পক্ষপাত সর্বত্র

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কাউন্টারিং ডিজিটাল হেট্রেডের (সিসিডিএইচ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ভারতে নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছর বিশ্বব্যাপী মুসলমান ও ইসলামবিদ্বেষী ৮৯ শতাংশ পোস্ট সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।

সিসিডিএইচ জানায়, একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো ইহুদিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী পোস্ট অপসারণে ব্যর্থ হয়েছে।

ভারতের হায়দরাবাদের সংখ্যালঘু অধিকারকর্মী এস কিউ মাসুদ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘৃণামূলক বক্তব্য বন্ধ করার চেয়ে মুসলমান ব্যবহারকারীদের বাধা দিয়ে দিতে বেশি উৎসাহী দেখা যায়।

বুম ও অল্ট নিউজের প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়, গত জুনে ওডিশায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে দুর্ঘটনা নিয়ে প্রচুর ভুয়া অভিযোগ আসতে থাকে। এমনও অভিযোগ উঠেছিল, স্টেশন মাস্টারকে ঘটনার জন্য দায়ী করে বলা জয়, তিনি একজন মুসলমান। ঘটনার পর তিনি পাশের এক মসজিদে আত্মগোপন করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রাটগার্স স্কুল অব কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশনের সহকারী অধ্যাপক কিরণ গরিমেলা বলেন, সমাজে এ ধরনের বয়ানের প্রতি সমর্থন আছে বলে এসব বার্তা ভাইরাল হয়। এসব প্ল্যাটফর্ম কেবল পক্ষপাতের বিস্তারকে সহজ করে দেয়।