ভোট হলে নতুন সভাপতি, না হলে কী হবে

সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী
ছবি: রয়টার্স

প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে আগামী ১৯ অক্টোবর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে গান্ধী পরিবারের বাইরে নতুন কাউকে দেখা যাবে। কিন্তু নির্বাচনে কেউ যদি আগ্রহী না হন, তাহলে কী হবে—এটাই এ মুহূর্তে বড় প্রশ্ন। কারণ, গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে দলের দায়িত্ব নেওয়ার দাবিতে রাহুল গান্ধী এখনো অনড়।

এ অবস্থায় গতকাল রোববার কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি সভাপতি পদে নির্বাচনের সূচি প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২২ সেপ্টেম্বর ভোটের নোটিশ জারি হবে। ২৪ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে ১ অক্টোবর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৮ অক্টোবর। সেদিন যদি দেখা যায়, সভাপতি পদে এক বা একাধিক নাম এসেছে তাহলে প্রার্থীরা প্রচারের জন্য সময় পাবেন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত। ১৭ অক্টোবর প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কংগ্রেসের প্রধান কার্যালয়ে ভোট গ্রহণ হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৯ অক্টোবর। এর আগে এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেই নির্বাচন হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল ২৮ আগস্ট। কিন্তু পরে তা এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়।

কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা এখনো নিশ্চিত নন রাহুল গান্ধীকে শেষ পর্যন্ত সভাপতি হতে রাজি করানো যাবে কি না। মায়ের সঙ্গে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই দল ছেড়েছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদ। আজাদের সঙ্গে জম্মু–কাশ্মীরের ১০ বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাও দল ছাড়েন। এরপর রাজ্যসভায় কংগ্রেসের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাঁরা সবাই রাহুলের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করবেন, যাতে তিনি সভাপতির পদ গ্রহণে বাধ্য হন। সমভাবাপন্ন নেতাদের সঙ্গে কথা বলে খাড়গে বলেন, দলে এ মুহূর্তে এমন একজনও নেই, যিনি রাহুলের মতো নেতৃত্ব দিতে পারবেন। সবাইকে নিয়ে চলার পক্ষে রাহুলই একমাত্র নেতা। একমাত্র তিনি পারবেন দলকে একজোট করে নেতৃত্ব দিতে।

তবে মুশকিল হচ্ছে, রাহুল নিজেই প্রস্তুত নন এবং বিভিন্ন সময় সে কথা তিনি প্রকাশ্যে একাধিকবার বলে দিয়েছেন। শুধু তিনি নন, তিনি চান গান্ধী পরিবারের কেউ যেন এই দায়িত্ব না নেন। সে কারণেই নির্বাচনের প্রস্তুতি।

২০২০ সালের আগস্টে গুলাম নবী আজাদের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ২৩ নেতা সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখে সর্বস্তরীয় নির্বাচন ও সব সময়ের জন্য সভাপতি থাকার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। সেই গুলাম নবী আজাদ দল ছেড়ে যাওয়ার পর বর্তমান কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, ওটা ছিল আজাদের দলত্যাগের প্রস্তুতি। তাই যদি না হবে তাহলে এখন সভাপতি পদে নির্বাচন ও ‘ভারত জোড় যাত্রা’র আগমুহূর্তে তিনি এভাবে দলকে অপদস্থ করতেন না। এই নেতারা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন, তখন থেকেই আজাদ বিজেপির হাতে খেলতে শুরু করেছেন। এখন তিনি চাইছেন বিজেপির সাহায্য নিয়ে জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হতে।

মল্লিকার্জুন খাড়গে, জয়রাম রমেশ, কে সি বেনুগোপাল, মধুসূদন মিস্ত্রির মতো নেতারা এখন দাবি করছেন, এত দিন ধরে যাঁরা দলে গণতান্ত্রিকতা ফেরানোর দাবিতে সরব ছিল সেই জি-২৩ গোষ্ঠীভুক্ত নেতারা সভাপতি নির্বাচনে অংশ নিন। ওই দলে আজাদের সঙ্গে ছিলেন কপিল সিব্বাল ও জিতিন প্রসাদ। সিব্বাল কংগ্রেস ছেড়ে সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে রাজ্যসভায় এসেছেন, জিতিন প্রসাদ গেছেন বিজেপিতে। বাকিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিক্ষুব্ধ বলে পরিচিতদের মধ্যে রয়েছেন আনন্দ শর্মা, মনীশ তিওয়ারি, পৃথ্বীরাজ চৌহান ও রাজ বব্বর। গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের মধ্যে পরিচিতরা হলেন কেরালার সংসদ সদস্য শশী থারুর ও সাবেক সংসদ সদস্য পি জে কুরিয়ন, হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডা, মহারাষ্ট্রের মুকুল ওয়াসনিক ও মিলিন্দ দেওরা, দিল্লির সন্দীপ দীক্ষিত, অন্ধ্র প্রদেশের রেনুকা চৌধুরী এবং কর্ণাটকের বীরাপ্পা মইলি। শশী থারুরের মতো এঁদের অনেকেই এখন আর ততটা বিদ্রোহী নন। এখন প্রকাশ্যে দলের সমালোচনাও তাঁরা করছেন না। এখনো মুখর বলতে হিমাচল প্রদেশের আনন্দ শর্মা, পাঞ্জাবের লোকসভা সদস্য মনীশ তিওয়ারি ও পৃথ্বীরাজ চৌহান। গান্ধী পরিবারের অনুগতরা চাইছেন, জি–২৩ গোষ্ঠীভুক্তরা এসব নেতা নির্বাচনে দাঁড়ান। জিতুন। দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। না হলে হয় চুপ থাকুন নয়তো দল ছেড়ে চলে যান। এই চাপ সৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

কংগ্রেসের সাম্প্রতিক চরিত্র অনুযায়ী, গান্ধী পরিবারের সমর্থন ছাড়া কারও পক্ষে সভাপতি হওয়া সম্ভব নয়। সেটা সে নির্বাচন বা মনোনয়ন যা–ই হোক। সেই জন্য গান্ধী পরিবারের অনুগামী নেতাদের প্রথম চেষ্টা রাহুলের সঙ্গে আরও একবার কথা বলে তাঁকে রাজি করানো। খাড়গে সরাসরিই তা জানিয়ে দিয়েছেন। রাহুল তবু রাজি না হলে দ্বিতীয় উপায় সোনিয়া গান্ধীকে সভাপতি পদে রেখে দেওয়া। শারীরিক কারণে সোনিয়া রাজি না হলে তৃতীয় প্রস্তাব তাঁকে সভাপতি রেখে তাঁর আস্থাভাজন একজনকে কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট করা, যাতে সোনিয়ার ওপর দৈনন্দিন চাপ না থাকে। কিন্তু তাতেও সোনিয়া রাজি না হলে চতুর্থ প্রস্তাব সভাপতি পদে পরিবারের পছন্দ অনুযায়ী কাউকে বেছে নেওয়া। এ ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট। কিন্তু গেহলট মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হচ্ছেন না। আগামী বছর রাজস্থান বিধানসভার ভোট। দুই দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে চান গেহলট।

মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়লে সেই পদে তাঁকে মেনে নিতে হবে রাজ্যে দলের প্রধান প্রতিপক্ষ শচীন পাইলটকে। এটা তিনি চাইছেন না। গেহলটকে তাই রাজি করানো না গেলে পঞ্চম প্রস্তাব হিসেবে উঠে আসছে মহারাষ্ট্রের প্রবীণ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম।
নির্বাচনী সূচি ঘোষণার পরে কংগ্রেস হাইকমান্ডকে এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তার ওপরেই নির্ভর করবে আগামী বছরে ৯টি রাজ্যের বিধানসভা ও ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের সম্ভাব্য ভাগ্য।