পাকিস্তানে হামলা নিয়ে মোদি কি পার্লামেন্টে বিরোধীদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে চান না
ভারতীয় সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন আজ সোমবার থেকে শুরু হলো। প্রথম দিনেই প্রত্যাশিতভাবে পেহেলগাম–কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নাম দিয়ে পাকিস্তানে হামলা নিয়ে বিরোধীদের প্রতিরোধের মুখে দুই কক্ষের অধিবেশন ব্যাহত হয়েছে।
পেহেলগাম–কাণ্ডে গোয়েন্দা ব্যর্থতা, অপারেশন সিঁদুরে একাধিক যুদ্ধবিমান হারানো, যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৃতিত্ব দাবি, বাণিজ্য হুমকি অথবা বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের অতি তৎপরতা নিয়ে সরকারকে কোণঠাসা করতে বিরোধীরা কোমর কষেছেন।
গত রোববারের সর্বদলীয় বৈঠকে এসব বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয় আলোচনায়’ সরকারের সম্মতির কথা জানিয়েছেন সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। তবু বিরোধীরা সংশয়ী আলোচনার চরিত্র ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জবাবদিহিতে বাধ্য করা যাবে কি না, তা নিয়ে।
সংশয়ের কারণ, গত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদি একবারের জন্যেও সংসদে কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। বিরোধীদের তোলা বিতর্কিত কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। একবারের জন্যও বিরোধীদের আনা কোনো মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি; বরং বারবার বিরোধীদের বক্তব্য সবার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এবারের অধিবেশন ব্যতিক্রমী হয় কি না, সেটিই প্রধান আকর্ষণ। আজ সোমবার দুই কক্ষেই অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটল। বিরোধীরা পেহেলগাম ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আলোচনার দাবি তোলেন। এ নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে দুই কক্ষের অধিবেশনই সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাজেট ও বর্ষাকালীন অধিবেশনের মধ্যে পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও তারপর অপারেশন সিঁদুর বিরোধীদের জোটবদ্ধ করে তুলেছে। প্রত্যাঘাতে পিছপা হয়নি ভারত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হয়েছে চার দিনের যুদ্ধ। হুট করে সেই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছে, যার কৃতিত্ব নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
১০ মে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে ওয়াশিংটন থেকে। সেই থেকে এ যাবৎ অন্তত ২৪ বার ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর হুমকিতেই ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। দুই দেশকেই তিনি বাণিজ্য নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যদিও ভারতের চিরকালীন অবস্থান তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে।
এ যুদ্ধে ভারতের একাধিক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে বলেও পাকিস্তান দাবি করেছে। সেই দাবি কতটা সত্যি, কতটাই–বা অতিরঞ্জিত, তার মীমাংসা এখনো হয়নি। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীও তা স্পষ্ট করেনি, যদিও চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান বলেছিলেন, ক্ষয়ক্ষতি যুদ্ধের অঙ্গ। ক্রিকেটে যেমন কটা উইকেট পড়ল সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা জয় কার হলো সেটিই।
এই বির্তক ও জিজ্ঞাসার মধ্যেই ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য, নষ্ট হয়েছে অন্তত পাঁচটা যুদ্ধবিমান। তবে তা কোন দেশের, সে কথা তিনি বলেননি। আজ সোমবার দুই কক্ষেই বিরোধীরা এসব বিষয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন। দেখা যাক, বিরোধীরা সেই খতিয়ান দিতে সরকারকে বাধ্য করতে পারেন কি না।
পেহেলগামে হামলা ও যুদ্ধ ছাড়া এ সময়ে বড় বিতর্কে জড়িয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের অসিলায় তাদের বিরুদ্ধে নাগরিকত্ব প্রমাণের অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, কমিশনের মাধ্যমে সরকার অন্যভাবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে।
বিহারের ভোটার তালিকা বিতর্কটি এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। এসব নিয়ে সরকারকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে চান বিরোধীরা। সেই সুযোগ সরকার কি বিরোধীদের দেবে? প্রশ্ন সেটি নিয়েও।
গত রোববারের সর্বদলীয় বৈঠকে সংসদীয়মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, সরকার সব বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয় আলোচনায়’ প্রস্তুত। দেখার বিষয় এটাই, বিতর্কে অংশ নিলেও বিতর্কের জবাব প্রধানমন্ত্রী দেন কি না। পেহেলগাম–কাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে নিজে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে। সংসদে এ নিয়ে বিতর্কের জবাব দেওয়ার দায়িত্বও রাজনাথকেই দেওয়া হতে পারে। এবং সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান না–ও দেওয়া হতে পারে।
বিদেশে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের পাঠানোর সিদ্ধান্তে কোন উপকারটা ভারতের হয়েছে, তা নিয়েও বিরোধীরা নানান প্রশ্ন তুলেছেন। সংসদে এসব উত্তর দেওয়ার ভার দেওয়া হতে পারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে।
ট্রাম্পের দাবি নিয়ে এখনো মোদি একবারও মুখ খোলেননি। যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতির প্রতি ভাষণে শুধু বলেছিলেন, ভারতের আক্রমণে দিশেহারা পাকিস্তানই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল। দেখার বিষয় এটাই—ট্রাম্পের ‘অসত্য ভাষণ’ নিয়ে সংসদে মোদি কিছু বলেন কি না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অসত্য ভাষণের অভিযোগ আজ পর্যন্ত মোদি আনেননি।
আজ অধিবেশনের শুরু হয় বিরোধীদের তোলা এসব দাবির মধ্য দিয়ে। দুই কক্ষেই পেহেলগামকাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুর নিয়ে একাধিক মুলতবি প্রস্তাব পেশ করা হয়; কিন্তু যথারীতি লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান তা গ্রাহ্য করেননি। বিরোধীদের দাবিতে প্রশ্নোত্তর পর্ব বাধা পেলে দুই কক্ষই বেলা ২টা পর্যন্ত মুলতবি করে দেওয়া হয়।
সংসদের অধিবেশন শুরু হলেও আগামী বুধবার চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাজ্য ও মালদ্বীপে যাবেন। অর্থাৎ অধিবেশনের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহি করানোর সুযোগ বিরোধীরা পাচ্ছেন না। তবে অধিবেশন শুরুর আগেই সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গোটা পৃথিবী ভারতের সামরিক শক্তির পরিচয় পেয়েছে।