এবার চীনের নাগরিক সন্দেহে উত্তরাখন্ডে ত্রিপুরার ছাত্রকে ছুরিকাঘাতে হত্যা

ত্রিপুরাসহ উত্তর–পূর্ব ভারতে অ্যাঞ্জেল চাকমা হত্যার বিচারের দাবি উঠেছেছবি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স থেকে নেওয়া

ধর্মীয়, জাতিগত কিংবা আঞ্চলিক হিংসার পাশাপাশি ভারতের বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে জাতিগত হিংসাও কি যুক্ত হতে শুরু করেছে? প্রশ্নটি উঠেছে উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুনে ‘চীনা’ সন্দেহে ত্রিপুরা রাজ্যের এক ছাত্রকে খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

এই ছাত্র খুনকে কেন্দ্র করে ভারতের ত্রিপুরায় সাধারণ মানুষ যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা গতকাল রোববার এই বিষয়ে কথা বলেন উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামির সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী ধামি দোষীদের গ্রেপ্তার করে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।
ত্রিপুরা ও উত্তরাখন্ড দুই রাজ্যই বিজেপিশাসিত।
ত্রিপুরার নিহত তরুণের নাম অ্যাঞ্জেল চাকমা। ত্রিপুরার ঊনকোটির বাসিন্দা অ্যাঞ্জেল দেরাদুনের এক প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় বর্ষের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

অভিযোগ, গত ৯ ডিসেম্বর অ্যাঞ্জেল ও তাঁর ছোট ভাই মাইকেল দেরাদুনের এক বাজারে গিয়েছিলেন দৈনন্দিন জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে। সেখানে স্থানীয় ছয় তরুণ তাঁদের ‘চীনা’ ও ‘মোমো’ বলে টিটকিরি দেয়। উত্ত্যক্ত করতে থাকে।

এ অবস্থায় অ্যাঞ্জেল ও মাইকেল তাঁদের বলেন, তাঁরা আদৌ চীনের নাগরিক নন। পুরোপুরি ভারতীয়। ত্রিপুরার অধিবাসী। পড়াশোনার জন্য এসেছেন। ভারতীয় পরিচয় পর্যন্ত তাঁরা দিতে চান। বিষয়টি নিয়ে এক পর্বে তর্ক শুরু হলে অ্যাঞ্জেলকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তাঁকে মাথা ও পিঠে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

টানা ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত শুক্রবার অ্যাঞ্জেলের মৃত্যু হয়। তাঁর মরদেহ ত্রিপুরায় নিয়ে যাওয়ার পর আগরতলায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সেই চাপের মুখেই মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা ফোন করেন উত্তরাখন্ডের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিকে।

অ্যাঞ্জেলের বাবা তরুণ প্রসাদ চাকমা বিএসএফের হেড কনস্টেবল। মণিপুরে পোস্টিং। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অ্যাঞ্জেল দেরাদুনে গিয়েছিলেন এমবিএ পড়তে। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় বসার আগেই তিনি এক সংস্থায় চাকরিও পেয়েছিলেন। পরীক্ষা শুরুর আগের দিনই তিনি আক্রান্ত হলেন।

মানিক সাহা জানান, মুখ্যমন্ত্রী ধামি তাঁকে বলেছেন, ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি একজন অভিযুক্ত নেপালে পালিয়ে গেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী ধামি জানিয়েছেন, অভিযুক্তকে ধরতে পুলিশের একটি দল নেপালে গেছে।

এ খুনের ঘটনায় উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। ত্রিপুরার তিপ্রা মথা পার্টির নেতা প্রদ্যোৎ বিক্রম মানিক্য দেববর্মার সঙ্গে কনরাড সাংমা সম্প্রতি ‘ওয়ান নর্থইস্ট পার্টি’ নামে একটি মঞ্চ গঠন করেছেন।

নিহত ব্যক্তির পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে এই দুই নেতা বলেন, উত্তর–পূর্বাঞ্চলের মানুষও আর পাঁচজনের মতো ভারতীয়। এই আঘাত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নয়, গোটা অঞ্চলকে করা হয়েছে।

উত্তর–পূর্বাঞ্চলের যুব সম্প্রদায়কে দিল্লিসহ বিভিন্ন প্রদেশে হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। ইদানীং সেই প্রবণতা কিছুটা কমেছিল বলে মনে হচ্ছিল; কিন্তু অ্যাঞ্জেলের মৃত্যু সেই ধারণা ভুল প্রতিপন্ন করল।

সম্প্রতি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে ঘৃণা অপরাধের ঘটনা বেড়ে গেছে। চলতি মাসেই দুজন পরিযায়ী শ্রমিক ঘৃণা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ওডিশার সম্বলপুরে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের জুয়েল রানাকে (১৯) বাংলাদেশি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর সঙ্গে যাওয়া দুই সহকর্মী আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।

ছত্তিশগড় থেকে কেরালার পালাক্কাড়ে কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন ৩১ বছরের রামনারায়ণ বাঘেল। তাঁকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। মারধরের সময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল বাংলাদেশি কি না।

ওডিশাতেই ঝাড়সুগুদা জেলায় নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে যাওয়া চার শ্রমিক। গত বুধবার তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ দাগিয়ে মারধর করে আটকে রাখা হয়। পরে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে। ওই ঘটনার পর তাঁরা সবাই পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন।

চলতি বছর বড়দিন উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও আরএসএসের কর্মীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। গোরক্ষকদের হাতে দলিত ও মুসলিমদের নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে; কিন্তু এবারই প্রথম ‘চীনা’ সন্দেহে কাউকে আক্রান্ত হতে দেখা গেল।

ওডিশায় জুয়েল রানাকে পিটিয়ে মারার পর জম্মু–কাশ্মীরের পিডিপি নেত্রী ইলতিজা মুফতি ‘এক্স’ হ্যান্ডলে লেখেন, ‘ইন্ডিয়া, ভারত বা হিন্দুস্তান নয়, তোমার নাম এখন লিঞ্চিস্তান (গণপিটুনির দেশ)।’