একটি পর্যটনস্থান যেভাবে মৃত্যুর সেতু হয়ে উঠল

গুজরাটের মরবির ঝুলন্ত সেতুটি গত রোববার সন্ধ্যায় হঠাৎ ভেঙে পড়ে
ছবি: রয়টার্স

ভারতের গুজরাট রাজ্যের মরবিতে ঝুলন্ত সেতু দুর্ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

গত রোববার সন্ধ্যায় সেতুটি হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এ সময় সেতুতে আনুমানিক ৫০০ মানুষ ছিল। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ১৩৫ জন নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি। মরবির এই ঘটনাকে ভারতের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

১৩৭ বছরের পুরোনো সেতুটি মেরামতের পর গত ২৬ অক্টোবর সর্বসাধারণের জন্য আবার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। তাহলে ঠিক কী হলো, কী কারণে সেতুটি ভেঙে পড়ল?

ট্র্যাজেডির সুলুক সন্ধানে দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, উদ্ধারকাজে প্রথম সাড়া দেওয়া লোকজন, স্থানীয় সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির গীতা পান্ডে।

দুর্ঘটনার জন্য স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিকেরা সেতুটি পরিচালনাকারী সংস্থাকে দোষারোপ করছেন। ব্যর্থতার জন্য পুলিশ ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকেও অভিযুক্ত করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তগুলো

স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের পর মহেশ চাভদা ও তাঁর দুই বন্ধু টিকিট কেনেন। টিকিট কিনে তাঁরা ঝুলন্ত সেতুতে পা রাখেন।

রাজ্যের পর্যটনবিষয়ক ওয়েবসাইটে সেতুটিকে একটি ‘প্রযুক্তিগত বিস্ময়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেতুটি দর্শনার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ছোটবেলা থেকেই সেতুটি মহেশের ভ্রমণের প্রিয় একটি জায়গা।
মহেশ বলেন, ‘আমি আমার মা–বাবার সঙ্গে সেতুটি দেখতে যেতাম। কয়েক বছর ধরে আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে প্রতি রোববার সেতুতে যেতাম।’

গত সপ্তাহে মহেশ যখন শোনেন, সেতুটি সর্বসাধারণের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি আনন্দে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

১৮ বছর বয়সী মহেশ ও তাঁর বন্ধুরা রোববার সন্ধ্যায় তাঁদের আগের রুটিন অনুযায়ী, সেতুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর দুর্ঘটনার শিকার হন তাঁরা।

আহত মহেশ গলায় প্লাস্টার নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় বসে বলেন, তাঁরা সেতুটির দিকে এগিয়ে যান। সেতুটিতে উপচে পড়া ভিড় দেখতে পান।

মহেশ বলেন, ‘তাই ভেবেছিলাম, আমরা একটু অপেক্ষা করব। কিন্তু টিকিট পরীক্ষক বললেন, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যেই মুহূর্তে পা রাখলাম, সেই মুহূর্তে সেতুটি ভেঙে পড়ল।’

সেতুটি ভেঙে পড়লে মহেশ ও তাঁর বন্ধুরা নদীতে পড়েন। তাঁরা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।

সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে যাওয়া অনেকে বেঁচে ফিরতে পারেননি। এই দুর্ঘটনায় অনেক পরিবার শেষ হয়ে গেছে। অনেক পরিবারের একাধিক সদস্য দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।

মেরামত নিয়ে অভিযোগ

অনেকেই এখন প্রশ্ন করছেন এত বড় ট্র্যাজেডি কীভাবে ঘটল, কেন তা প্রতিরোধ করা যায়নি?

গুজরাটি নববর্ষের সঙ্গে মিল রেখে গত বুধবার সেতুটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল।

সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য ২০০৮ সাল থেকে চুক্তিবদ্ধ ওরেভা গ্রুপ। ফার্মটির মালিক জয়সুখ ভাই প্যাটেল। সেতুটি আবার চালুর এক দিন আগে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে জয়সুখ বলেছিলেন, সেতুর সংস্কারকাজে দুই কোটি রুপি খরচ হয়েছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, জয়সুখ আরও বলেছিল, ‘আগামী ৮ থেকে ১০ বছরে সেতুটির কিছুই হবে না। যদি সেতুটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ১৫ বছরের মধ্যে কোনো মেরামতের প্রয়োজন হবে না।’

সেতুটির মেরামত কাজের গুণমান, যন্ত্রপাতি ও ফার্মটি যে ঠিকাদার নিয়োগ করেছিল, তারও প্রশংসা করেছিলেন জয়সুখ।

দুর্ঘটনার পর ওরেভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৯ ব্যক্তি গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে দুজন ব্যবস্থাপক, দুজন টিকিট বিক্রেতা, দুজন ঠিকাদার ও তিনজন নিরাপত্তারক্ষী।

অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ওরেভার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি।

কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, সেতুটির মাঝামাঝি অংশে অনেক বেশি লোক ছিল। কেউ কেউ সেতুটিকে দোলানের চেষ্টা করছিল।

সেতুটি পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে ব্যর্থ হওয়াসহ অন্যান্য অভিযোগও ওরেভার বিরুদ্ধে উঠেছে।

স্থানীয় পৌরসভার প্রধান সন্দীপসিংহ জালা গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, সেতুটি পুনরায় চালুর আগে ওরেভাকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।

তবে ঘড়ি তৈরির জন্য পরিচিত একটি কোম্পানিকে (ওরেভা) কেন সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। কোম্পানিটি বাল্ব, ব্যাটারিচালিত বাইক, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতিও তৈরি করে।

বক্তব্য জানতে বিবিসি সন্দীপসিংহকে ফোন করে। তাঁকে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

তবে সন্দীপসিংহের কার্যালয়ের একজন সহকারী বিবিসিকে বলেন, ওরেভা প্রথমে ২০০৮ সালে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সেতুটি লিজ নেয়। লিজের চুক্তিটি গত মার্চ মাসে নবায়ন করেন সন্দীপসিংহ।

চুক্তির একটি অনুলিপি দেখেছে বিবিসি। চুক্তিটির মেয়াদ ২০৩৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। চুক্তিতে বলা আছে, সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ফার্মের। তারা টিকিট বিক্রি থেকে আয় করবে।

সেতু দুর্ঘটনার পূর্ণ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।