চন্দ্রযান–৩: চাঁদে ভারতের খুঁজে পাওয়া তথ্য কী কাজে লাগবে

গ্রাফিক চিত্রে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার ও রোভার
গ্রাফিক: ইসরো

চাঁদে অভিযানে গিয়ে গত মাসে ইতিহাস গড়েছে ভারত। ওই সময় চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ভারতীয় চন্দ্রযান–৩। এর আগে আর কোনো দেশের নভোযান চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেনি।

চন্দ্রযান–৩–এর দুটি অংশ। ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করে বিক্রম ও প্রজ্ঞান। চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে ও ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠায়। এসব তথ্য ও ছবি গবেষণার কাজে ব্যবহার করবে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)।

ইসরো জানিয়েছে, চলতি মাসের শুরুর দিকে বিক্রম ও প্রজ্ঞানকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এ দুটির ব্যাটারি সূর্যের আলো থেকে চার্জ নেয়। এরপর কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। চাঁদের পরিবেশে এখন সূর্য অস্ত গেছে। ২২ সেপ্টেম্বর নাগাদ নতুন চান্দ্রদিবস শুরু হবে। এক চান্দ্রদিবস পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান। ওই সময় বিক্রম ও প্রজ্ঞান আবার সক্রিয় হতে পারে।

তবে গতকাল শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাতে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত চন্দ্রযান–৩ থেকে কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, চন্দ্রযান–৩ এখনো নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

এর আগে চাঁদের পৃষ্ঠে তোলা ছবি ও সংগ্রহ করা হালনাগাদ তথ্য সবাইকে জানিয়েছে ইসরো। এতে অনেক ভারতীয় বেশ উৎফুল্ল। তাঁদের মতে, মহাকাশ গবেষণায় এটা ভারতের বড় একটি অর্জন। কিন্তু অনেকের প্রশ্ন, চন্দ্রাভিযান থেকে পাওয়া তথ্য–ছবি আদতে কী কাজে লাগবে?

এ বিষয়ে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে মিলা মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। মিলা মিত্র মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার সাবেক বিজ্ঞানী। সেই সঙ্গে মিলা মিত্র দিল্লিভিত্তিক মহাকাশ শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টেম অ্যান্ড স্পেসের সহপ্রতিষ্ঠাতা। চন্দ্রযান–৩–এর খুঁজে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন তিনি।

দূরত্ব ও যোগাযোগ

রোভার প্রজ্ঞানে ছয়টি চাকা রয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে এটি এক সেন্টিমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম। ২ সেপ্টেম্বর যখন প্রজ্ঞান আপাতত নিষ্ক্রিয় হয়, তার কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরো জানায়, চন্দ্রপৃষ্ঠে ১০০ মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে এটা। প্রজ্ঞানের জন্য এটা বেশ অনেকটা পথ।

মিলা মিত্রের মতে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ চাকা থাকায় চাঁদের এবড়োখেবড়ো পৃষ্ঠে প্রজ্ঞান নিরাপদে চলতে পেরেছে। যদিও প্রজ্ঞান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে এর চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রজ্ঞান ছবি তুলে, তথ্য সংগ্রহ করে সেসব ল্যান্ডার বিক্রমে পাঠায়। সেখান থেকে কক্ষপথ হয়ে সেসব পৃথিবীতে আসে। এর জন্য অল্প কিছু সময় লাগে। প্রমাণিত হয়েছে, এই দুটি দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনে পারদর্শী।

আরও পড়ুন

তাপমাত্রার তারতম্য

ল্যান্ডার বিক্রম চন্দ্রপৃষ্ঠের এবং চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ সেন্টিমিটার নিচের তথ্য সংগ্রহ করেছে। দেখা গেছে, ওপর ও নিচের তাপমাত্রায় চরম পার্থক্য রয়েছে। চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও এর পৃষ্ঠের প্রায় ৩ ইঞ্চি নিচে তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেখা গেছে।

নাসা আগেই জানিয়েছে, চাঁদে চরম বৈরী তাপমাত্রা বিরাজ করে। দিনের বেলায় ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। আবার রাতে তা মাইনাস ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এমনকি মাইনাস ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়েছে।

মিলা মিত্রের মতে, চাঁদে ভারতের অভিযান থেকে সেখানকার তাপমাত্রা নিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। জানা গেছে, চাঁদের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা অপরিবাহী। এর ফলে চাঁদে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে তাপ, শীত ও বিকিরণকে দূরে রাখতে এই জ্ঞান কাজে লাগানো যাবে। এটি চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচে বরফের উপস্থিতির একটি সূচক হতে পারে।

ভারতের চন্দ্রযান-৩–এর পাঠানো চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি
ইসরোর সৌজন্যে

সালফারের উপস্থিতি

রোভার প্রজ্ঞানে বসানো একটি লেজার ডিটেক্টর চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছে চন্দ্রপৃষ্ঠে রাসায়নিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করে। এ সময় অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্রোমিয়াম, টাইটানিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকনের উপস্থিতি খুঁজে পায়। ইসরো জানিয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সালফারের উপস্থিতি শনাক্ত।

মিলা মিত্রের মতে, চন্দ্রপৃষ্ঠে সালফারের উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ। সালফার সাধারণত আগ্নেয়গিরি থেকে আসে। তাই চাঁদের গঠনপ্রক্রিয়া ও ভৌগলিক অবস্থা নিয়ে গবেষণায় এ তথ্য কাজে লাগবে। এ ছাড়াও সালফার বেশ ভালো সার। তাই চাঁদে বসতি গেড়ে গাছপালা বড় করতে এটা কাজে লাগানো যেতে পারে।

চন্দ্রে কম্পন

ল্যান্ডার বিক্রমে এমন একটি যন্ত্র বসানো আছে, যেটা আশপাশের কম্পন শনাক্ত ও পরিমাপ করতে পারে। ইসরো জানিয়েছে, লুনার সিসমিক অ্যাকটিভিটি নামের এই যন্ত্র সেখানে একটি কম্পন শনাক্ত করেছে। এটি শক্তিশালী ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এই কম্পন প্রাকৃতিক। হয়তো এটা চন্দ্রপৃষ্টে বড় কোনো উল্কার আঘাত। অথবা চাঁদে ভূমিকম্প হয়েছিল। গত শতকের সত্তরের দশকেও চাঁদে কম্পন শনাক্ত করা হয়েছিল। এখন নতুন করে কম্পনের তথ্য পাওয়ায় এ–সংক্রান্ত গবেষণা জোরদার হবে।

আরও পড়ুন

ছোট্ট উল্লম্ফন

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে আপাতত নিষ্ক্রিয় হওয়ার আগে ল্যান্ডার বিক্রমকে সেটার ইঞ্জিন পুনরায় সক্রিয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তখন সেটি ৪০ সেন্টিমিটার উঁচুতে উঠে যায়। পরে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার দূরে গিয়ে অবতরণ করে সেটি। এই পরীক্ষাকে সফল বলেছে ইসরো।

মিলা মিত্র বলেন, ইঞ্জিনটি পুনরায় চালু করার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটি এখনো ঠিকঠাক কাজ করছে। এ ছাড়া বোঝা গেছে, চাঁদের পরিবেশে ভারী জিনিস উত্তোলনের ক্ষমতা রয়েছে।

আরও পড়ুন