ষষ্ঠ দফা নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা বিজেপি-তৃণমূলের

পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারিফাইল ছবি: এএনআই

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ষষ্ঠ দফায় আগামীকাল শনিবার পশ্চিমবঙ্গের আট আসনে ভোট হবে। এর একটি হচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক আসন। এই আসনের নন্দীগ্রাম এলাকায় পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। সেখানে দুদিন আগে বিজেপির এক কর্মীকে হত্যা করা হয়। এর জেরে বাজারে দোকানপাট, বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

বিজেপির অভিযোগ, তাদের এক কর্মী রতিবালা আড়িকে দুদিন আগে হত্যা করেছে তৃণমূল। অন্যদিকে তৃণমূলের বক্তব্য, পারিবারিক অশান্তির কারণে খুন হয়েছেন রতিবালা। বিষয়টিকে তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে প্রধানত সংখ্যালঘু অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়েছে বিজেপি, ভোট মেরুকরণের লক্ষ্যে।

তমলুক আসনে বিজেপির প্রার্থী কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের যুবনেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। এই আসন এবারের নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূলের জন্য ‘প্রেস্টিজ’ বা সম্মান রক্ষার লড়াই।

প্রায় ২০ বছর ধরে বারবার সহিংসতার জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়েছে নন্দীগ্রাম। আর যেহেতু নির্বাচনের আগে একজন খুন হয়েছেন, তাই এই অঞ্চলে সহিংসতার আশঙ্কা প্রবল। ফলে এখানে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে।

অধিকারী পরিবারের ‘মান রক্ষার’ লড়াই

২০০৯ সাল থেকে এই আসনে জিতে আসছে পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারীর পরিবার। শুভেন্দু এখন বিধানসভায় বিরোধী দল বিজেপির নেতা হলেও তিনি নিজে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে এই আসনে জিতেছিলেন ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে এখান থেকে উপনির্বাচনে জেতেন তাঁর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী। ২০১৯ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনেও দিব্যেন্দু আসনটি জেতেন।

গত ১৫ বছরে এই প্রথম তৃণমূল কংগ্রেস থেকে অধিকারী পরিবারের কেউ তমলুক আসনে প্রার্থী হলেন না। এই আসনে এবার বিজেপির প্রার্থী সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী আর তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য।

বিজেপি সূত্রে জানা গেছে, শুভেন্দুই এই আসনে সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলীকে দাঁড় করিয়েছেন। অভিজিৎ সে রকম কিছুটা ইঙ্গিতও দিয়েছেন। এই আসনে যদি অভিজিৎ হেরে যান, তবে তা কার্যত শুভেন্দুর পরাজয় বলেই ধরে নেওয়া হবে।

তৃণমূলের প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেন, এই আসন জিততে মরিয়া শুভেন্দু সেখানে সহিংসতা চালাচ্ছেন, যাতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে আসনটি জেতা যায়। শুভেন্দু নিজে নন্দীগ্রাম আসন থেকে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দুই হাজারের কম ভোটে হারিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অতএব তমলুকের অন্তর্গত নন্দীগ্রাম অঞ্চলে বিজেপি এগিয়ে থাকে কি না, নজর থাকবে সেদিকেও। সব মিলিয়ে তমলুক আসন এবারের নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূলের জন্য সম্মান রক্ষার লড়াই।

শুভেন্দু অধিকারী তাঁর আরেক ভাই সৌমেন্দুকে প্রার্থী করিয়েছেন তমলুকের পাশের আসনে, পূর্ব মেদিনীপুরেরই কাঁথিতে। এই কাঁথি আসনটিও ২০০৯ সাল থেকে রয়েছে অধিকারী পরিবারের দখলে। পরপর তিনবার (২০০৯, ২০১৪, ২০১৯) এই আসন থেকে জিতেছেন শুভেন্দু-সৌমেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী। কিন্তু তিনি তিনবারই জিতেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়নে।

গোটা অধিকারী পরিবার গত পাঁচ বছরে তৃণমূল থেকে সরে গেছে বিজেপির দিকে। বিজেপির মনোনয়নে অধিকারী পরিবারের কোনো সদস্য এই আসনে প্রথম লড়ছেন। এই কারণে এই আসনটিও অধিকারী পরিবার বনাম তৃণমূলের সম্মান রক্ষার লড়াই। আগামীকালের নির্বাচনে মূলত নজর থাকবে এই দুই আসনে।

ষষ্ঠ দফায় কেন বিজেপির চ্যালেঞ্জ

তমলুক এবং কাঁথি ছাড়াও শনিবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল এবং মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং বিষ্ণুপুর। এই গোটা অংশ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ এবং পশ্চিমবঙ্গে। এই অঞ্চলে ২০ বা ৩০ শতাংশ আদিবাসী ভোট রয়েছে।

এই ছয় আসনের মধ্যে পাঁচটি (মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং বিষ্ণুপুর) ২০১৯ সালে পেয়েছিল বিজেপি। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রচার এবং প্রসার পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অঞ্চলে গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে হয়েছে। এ ছাড়া এই অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান শক্তি মুসলমান ভোট অপেক্ষাকৃতভাবে কম।

ফলে এই পাঁচ আসনে বিজেপিকে তাদের গতবারের ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতেই হবে, যদি তারা গতবারের মতো ৪২-এর মধ্যে ১৮ আসন পেতে চায়। দিন কয়েক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এবার পশ্চিমবঙ্গে ৪২-এর মধ্যে তাঁরা ৩০ আসন পাবেন। এই লক্ষ্যের ধারেকাছে যেতে হলে আগামীকাল আট আসনের মধ্যে প্রায় সব কটিই পেতে হবে বিজেপিকে।

মমতার মন্তব্যের প্রভাব

আরও যে বিষয়টিতে এই পর্যায়ে নজর থাকবে সেটি হচ্ছে, দিন কয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক হিন্দুধর্মীয় নেতাকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন। মনে করা হচ্ছে, এর জেরে ষষ্ঠ পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেটা সেভাবে গত পাঁচ দফার ভোটে এবার হয়নি। বিজেপি যদি এই পর্যায়ে তাদের আসন ধরে রাখতে পারে বা গতবারের তুলনায় বেশি পায়, তাহলে ধরে নিতে হবে এর একটি অন্যতম কারণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য।

১৮ মে হুগলির গোঘাটে এক নির্বাচনী জনসভায় মমতা বলেছিলেন, ‘সব সাধু সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবাই সমান? এই যে বহরমপুরের এক মহারাজ আছেন, কার্তিক মহারাজ। এই লোক বলেন, “তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেব না।” ফলে তাঁকে আমি সাধু মনে করি না। কারণ, তিনি সরাসরি রাজনীতি করে দেশের সর্বনাশ করছেন।’