ভারতে নারীরা নিজেদের ‘একা’ বলতে গর্ববোধ করেন

ভারতের শহরাঞ্চলের একা নারীদের ফেসবুকভিত্তিক কমিউনিটি গ্রুপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেলের সদস্য ও লেখক শ্রীময়ী পিউ কুণ্ডু
ছবি: পিউ কুণ্ডুর ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

ভারতে নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে ভালো স্ত্রী ও মা হবেন—পরিবার, সমাজ এমনটি ভাবে। নারীদেরও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য থাকে বিয়ে করা। কিন্তু সেই ঐতিহ্য ছেড়ে এখন বিপুলসংখ্যক নারী স্বাধীনভাবে একা থাকতে পছন্দ করছেন। এমন নারীর সংখ্যা ভারতে ক্রমে বাড়ছে।

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দক্ষিণ দিল্লির একটি ক্যারিবিয়ান লাউঞ্জে ২৪ জনের বেশি নারী এক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন। উপস্থিত নারীদের গল্প, আড্ডা আর হাসিতে মেতে ওঠে পুরো লাউঞ্জ। তাঁদের সবাই একা জীবন যাপন করছেন। তাঁরা সবাই ভারতের শহরাঞ্চলের ফেসবুকভিত্তিক একা নারীদের কমিউনিটি গ্রুপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেলের সদস্য।

ওই গ্রুপের সদস্য ও লেখক শ্রীময়ী পিউ কুণ্ডু বলেন, ‘আসুন, নিজেদের বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত বা অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দেওয়া বন্ধ করি। আমরা নিজেদের গর্বের সঙ্গে একা বা সিঙ্গেল হিসেবে পরিচয় দিই।’  

যে দেশে ‘বিয়ে’ নারীদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত, সে দেশে একা থাকলে নানা অপবাদ কুড়াতে হতে পারে। গ্রামীণ ভারতে অবিবাহিত বা একা নারীদের সাধারণত পরিবারের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। বিধবা নারীকে বৃন্দাবন ও বারানসীর মতো শহরে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

পিউ কুণ্ডুসহ ওই মধ্যাহ্নভোজে আসা নারীরা একটু আলাদা। তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তাঁদের কেউ শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী; কেউ উদ্যোক্তা, অধিকারকর্মী, লেখক আবার কেউবা সাংবাদিক। তাঁদের কেউ কেউ একা থাকেন, কারও বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, কেউ বিধবা। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা বিয়েই করেননি।

ভারতে শহুরে বিত্তবান পরিবারের একা নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাঁরা নিজেরাও ব্যাংক, গয়না প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ভোগ্যপণ্য কোম্পানি ও ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। একা নারীদের নিয়ে বলিউডে সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ হচ্ছে। একা নারীকে নিয়ে বলিউডের কুইন ও পিকু সিনেমা এবং ফোর মোর শটস প্লিজ ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করা হয়েছে। একা নারীকেন্দ্রিক এসব সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ ব্যবসায়িকভাবে সফলও হয়েছে।

গত অক্টোবরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করেছেন, বিবাহিত নারীদের মতো অবিবাহিত নারীদেরও গর্ভপাতের সমান অধিকার আছে। এই রুলের মাধ্যমে দেশটির শীর্ষ আদালত একা নারীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

এরপরও একা নারীদের প্রতি ভারতীয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আগের মতোই অনমনীয় রয়ে গেছে। পিউ কুণ্ডু বলেন, বিত্তশালী নারীদের জন্যও একা থাকা সহজ নয়। তাঁদের একই দৃষ্টিতে দেখা হয়। তিনি বলেন, ‘একা নারী হিসেবে আমি বৈষম্য ও অপমানের শিকার হয়েছি। আমি যখন মুম্বাইয়ে বাসাভাড়া নিতে গিয়েছিলাম, তখন ওই হাউজিং সোসাইটির সদস্যরা আমি মদ্যপান করি কি না এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শারীরিকভাবে সক্ষম কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন।’

পিউ কুণ্ডু বলেন, একবার তিনি একজন গাইনোকলজিস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওই চিকিৎসকও প্রতিবেশীদের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত প্রশ্ন করেছিলেন। কয়েক বছর আগে তাঁর মা বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজার সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এই বিজ্ঞাপন দেখে একজনের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন তিনি। ওই ব্যক্তি দেখা হওয়ার প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কুমারী কি না? তিনি বলেন, একা নারীদের এই প্রশ্ন নিয়মিত জিজ্ঞাসা করা হয়।

স্ট্যাটাস সিঙ্গেল মুম্বাই চ্যাপ্টারের সদস্যরা
ছবি: স্ট্যাটাস সিঙ্গেলের ব্লগ থেকে নেওয়া

২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় ভারতে ৭ কোটি ১৪ লাখ নারী একা ছিলেন, যা যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ভারতে ২০০১ সালের আদমশুমারির সঙ্গে ২০১১ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে একা নারীর সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০০১ সালে সংখ্যাটি ছিল ৫ কোটি ১২ লাখ। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালের আদমশুমারি শেষ হতে দেরি হচ্ছে। পিউ কুণ্ডু বলেন, এখন একা নারীর সংখ্যা ১০ কোটি পেরিয়ে যাবে।

অনেকেই ভারতে একা নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। কেউ বলছেন, ভারতে বিয়ে করার বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে। এর অর্থ, দেশটিতে বিপুলসংখ্যক একা বা অবিবাহিত নারীর বয়স কেবল কিশোরী পেরিয়েছে বা ২০ বছর বয়সের মধ্যে। আর একা নারীদের সংখ্যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক বিধবা নারীও আছেন। পুরুষদের তুলনায় নারী বেশি দিন বাঁচে বলে এই সংখ্যা বেড়েছে।

তবে পিউ কুণ্ডু বলেছেন, বিপুলসংখ্যক নারী কেবল পরিস্থিতির কারণে একা নন, অনেক নারীই এখন ইচ্ছাকৃতভাবে একা থাকতে পছন্দ করছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা নিজেদের পছন্দেই একা থাকেন। তাঁরা প্রথাগত বিয়ের ধারণা অস্বীকার করেন। কারণ, এটা পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যা নারীদের প্রতি অবিচার ও নিপীড়ন চালু রাখে।’

পিউয়ের মা বিধবা হওয়ার পর বেশ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। পিউ বলেন, ‘বড় হতে হতে দেখেছি, কীভাবে একজন নারীকে একজন পুরুষ সঙ্গীহীন করে দেয়; আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে নারীরা প্রান্তিক হয়ে পড়েন। চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের সময় তিনি (মা) অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। বিধবা নারীর ছায়া অশুভ বলে তাঁকে কনের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছিল।’

৪৪ বছর বয়সে পিউয়ের মা আবার বিয়ে করেন। এতে তিনি সমাজের রোষানলে পড়েন। সবাই অপমানজনক কথা বলতে থাকেন। পিউ বলেন, ‘এসব বিষয় আমার ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। আমি একসময় বিশ্বাস করতাম, বিয়ে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আনবে, আমার সব অন্ধকার দূর করে দেবে।’

দুবার প্রেমে পড়েছিলেন পিউ। কিন্তু ওই দুই সম্পর্কেই তিনি শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। কোনো সম্পর্কই আর সামনের দিকে এগোয়নি। ২৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছিল। সেই বিয়েও আর করেননি তিনি। পিউ বলেন, তিনি একসময় বুঝতে পেরেছিলেন, প্রথাগত বিয়েতে একজন নারীকে পুরুষের অধীনে থাকতে হয়। এটা তিনি পারবেন না। তাই আর বিয়ে করা হয়নি।

আদর্শ সম্পর্ক কখনো সংস্কৃতি, ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ওপর ভিত্তি করে হবে না; বরং সম্মান ও স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে তা হবে বলে মন্তব্য করেন পিউ।

ভারতে এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিরাজমান। এই সমাজে ৯০ শতাংশ বিয়ে পরিবারের সক্রিয় তদারকিতে হয়। এখানে নারী কাকে বিয়ে করবেন, একা থাকবেন নাকি আদৌ বিয়ে করতে চান না—এমন কথা খুব কমই বলতে পারেন।

দিল্লির কাছে গুরুগ্রামের লাইফ কোচে ৪৪ বছর বয়সী ভাবনা দাহিয়া কখনো বিয়ে করেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা সমুদ্রের একটি বিন্দু হতে পারি। কিন্তু ওই বিন্দু তো আছে। নারীদের একা থাকার উদাহরণ যত বেশি আছে, ততই ভালো। ঐতিহ্যগতভাবেই পরিবারে স্বামীর চাকরি, পরিকল্পনা ও সন্তানদের স্কুল নিয়ে আলোচনা হতো। নারীদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে আলোচনা তেমন একটা হতো না। কিন্তু এখন এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।’