যে কারণে মোদির বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কৃষকেরা

ভারতে বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন কৃষকেরাফাইল ছবি: রয়টার্স

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হয়েছে গত মঙ্গলবার। এই ফল দেখে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন দেশটির মহারাষ্ট্র রাজ্যের কৃষক নরেন্দ্র দাভানে। তাঁর মনে হচ্ছিল, জয়টা তাঁর পক্ষেই এসেছে।

মহারাষ্ট্রের যাবাতমাল জেলার দাভাদি গ্রামের বাসিন্দা দাভানে। একসময় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বড় সমর্থক ছিলেন। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদে বসার আগে দাভাদি গ্রামে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন মোদি। তখন রাজ্যের এ অঞ্চলে কৃষকদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।

তবে মোদি ক্ষমতায় বসার ১০ বছর পর কৃষকদের সেই সমস্যাগুলো আরও গভীর হয়েছে। নির্বাচনের আগে গত ফেব্রুয়ারিতেও যাবাতমালে গিয়েছিলেন মোদি। তখন নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন দাভানে। তবে পুলিশ উল্টো তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মোদি চলে যাওয়ার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এবারের নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে বিজেপির লোকসভা আসন নাটকীয়ভাবে কমেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে রাজ্যটির ৪৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২৩টিই পেয়েছিল নরেন্দ্র মোদির দল। আর সেবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ পেয়েছিল মোট ৪১টি আসন। তবে এবার সব মিলিয়ে ১৭টি আসন নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে তারা।

সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারতজুড়ে গ্রাম অঞ্চলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার হারিয়েছে এনডিএ।

শুধু মহারাষ্ট্রই নয়, ভারতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন অঞ্চলে এবার একই চিত্র দেখা গেছে। এক দশক ধরে ভারতের লোকসভায় আধিপত্যের পর এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বিজেপি। ৫৪৩ আসনের মধ্যে ২৪০ আসন পেয়েছে দলটি। অথচ ২০১৯ সালেই তারা পেয়েছিল ৩০৩টি আসন। এরপরও সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বিজেপি। তবে এ জন্য দলটিতে নির্ভর করতে হবে জোটসঙ্গীদের ওপর।

সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে ভারতের কৃষিভিত্তিক কয়েকটি রাজ্যে দাভানের মতো প্রান্তিক কৃষকেরা বিজেপির হাত ছেড়েছেন। যেমন হরিয়ানা। ‘ভারতের রুটির ঝুড়ি’ হিসেবে খ্যাত এই রাজ্যে ২০১৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১০টি আসনের সব কটি। এবার মাত্র পাঁচটি আসন পেয়েছে তারা। কংগ্রেস পেয়েছে বাকি পাঁচটি। পাঞ্জাবেও বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে।

আরও পড়ুন

রাজস্থানে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছিল বিজেপি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যটির ২৫ আসনের মধ্যে মাত্র ১৪টি পেয়েছে তারা। অথচ ২০১৯ সালে সব কটি আসন ছিল বিজেপির দখলে। এই রাজ্যের একটি আসনে এবার বিজেপিকে হারিয়েছেন সিপিআই-এমের প্রার্থী আমরারাম। কৃষকদের সমস্যাকে হাতিয়ার করে জয় পেয়েছেন এই কৃষক নেতা। রাজস্থানের ওই আসনে আগে কখনো জয়ের মুখ দেখেনি বাম দলটি।

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ৬৫ শতাংশ বাসিন্দা কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করেন। সেখানে ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টিতে জিতেছে বিজেপি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে সেখানে দলটি আসন পেয়েছিল ৬২টি। ২০১৪ সালে নির্বাচনে পেয়েছিল আরও বেশি—৭১টি আসন।

সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারতজুড়ে গ্রাম অঞ্চলে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২ দশমিক ২ শতাংশ ভোটার হারিয়েছে এনডিএ। অপর দিকে গ্রাম ও মফস্বল অঞ্চলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের ভোট বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এ নিয়ে পাঞ্জাবের কৃষিবিজ্ঞানী দেবিন্দর শর্মা বলেন, ‘আপনি যদি ভোটের ফলের দিকে তাকান, স্পষ্ট দেখতে পাবেন, গ্রাম এলাকায় বিজেপির খারাপ করার পেছনে বড় একটি কারণ হলো—নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ঘিরে কৃষকদের অসন্তোষ।’

আরও পড়ুন
২০২০ সালে কৃষক আন্দোলনকারীরা নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কৃষকদের অসন্তোষের পেছনে কী?

ভারতের সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ৫৩ হাজার ৪৭৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এর কারণ ছিল—ঋণ, কৃষিকাজে নিম্ন মজুরি ও বিরূপ আবহাওয়া। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, মোদি সরকারের সময় এই সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়েছে।

মোদি ক্ষমতায় আসার পর মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে কৃষকদের এই সমস্যা বেড়েছে বৈকি কমেনি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কংগ্রেস সরকারের আমলে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে ৯ হাজার ৬৭১ জন কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। আর মোদির আমলে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজার ১২২ জন কৃষক।

২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার সময় ভারতের কৃষি খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কথাও বলেছিলেন। তবে ২০২২ সালের প্রকাশিত সরকারি তথ্য বিপরীত চিত্র তুলে ধরছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে বর্তমানে কৃষকদের বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার ২১৮ রুপি, প্রতিদিনের হিসাবে যা মাত্র ২৮ রুপি।

আরও পড়ুন

ভারতের কৃষি খাতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০২০ সালে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন পাস করেছিল মোদি সরকার। যদিও ওই আইন প্রণয়নের আগে কৃষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। সরকারের ওই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সে বছর ব্যাপক আন্দোলন করেন কৃষকেরা। তাঁদের ভয় ছিল আইনগুলোর মাধ্যমে ভারতের কৃষি খাত করপোরেটদের হাতে চলে যাবে। তুলে নেওয়া হবে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) মতো রাজ্য সরকারের পক্ষ দেওয়া কৃষকদের সুরক্ষামূলক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।

ভারতে বর্তমানে কৃষকদের বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার ২১৮ রুপি, প্রতিদিনের হিসাবে যা মাত্র ২৮ রুপি।

ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত ওই আইনগুলো বাতিল করেছিল। তবে এ জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল কৃষকদের। আন্দোলনকারীদের রাজধানী নয়াদিল্লি অভিমুখে যাত্রা বন্ধ করতে মহাসড়কে ব্যারিকেড (প্রতিবন্ধকতা) দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী। অনেক কৃষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এমনকি নিরস্ত্র কৃষকদের ওপর গুলি করতে এবং ড্রোন থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তেও পিছপা হয়নি পুলিশ।

আন্দোলনের প্রভাব রাজনীতিতে

দেবিন্দর শর্মার মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিতর্কিত ওই সব আইনবিরোধী আন্দোলনই কৃষকদের রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেবিন্দর বলেন, পাঞ্জাবে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যার মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও তাঁদের লাভের হিসাবে ভাগ বসাচ্ছে। এরই মধ্যে সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো তাঁদের রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত হওয়ার একটি মঞ্চ করে দিয়েছে।

পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মতো রাজ্যে বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। অনেক গ্রামে দলটির প্রার্থীদের ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিজেপি নেতা প্রীনিত কাউরও। পাঞ্জাবের পাতিয়ালা থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, পাঞ্জাবে নির্বাচনটা হয়েছে কৃষক ও বিজেপির মধ্যে।

কয়েক বছর ধরে ভারতের পেঁয়াজচাষিরা তাঁদের পণ্যের দাম কম পাচ্ছেন। যেমন গত বছরে ৫১২ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করে সর্বনিম্ন ২ রুপি ৯০ পয়সা মুনাফা পেয়েছেন তাঁরা।

এই চিত্র শুধু পাঞ্জাবেই নয়। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চল তুলা চাষের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলে গত বছরজুড়ে তুলার দাম কমেছে। কৃষকেরা বলছেন, প্রতি কুইন্টাল তুলার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ৬ হাজার ৬২০ রুপি ধরেছে সরকার। এই দাম কৃষি পণ্যটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অন্তত ১০ হাজার রুপি করতে হবে। এরই মধ্যে আবার উচ্চ মানের তুলা আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে সরকার। ফলে দেশি তুলার দাম আরও কমেছে।

বিদর্ভ অঞ্চলের কৃষক ও আইনজীবী বৈভব পণ্ডিত বলেন, এই বিষয়গুলো কৃষকদের ভোটদানে প্রভাব ফেলেছে। এমনকি তরুণ কৃষক—যাঁরা রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে মাথা ঘামান না, তাঁরাও এটা দেখতে পেয়েছেন যে ফসলের দাম যখন কমছে, তখন উৎপাদনের খরচ বেড়েই চলেছে। এই হতাশার মধ্যে উত্তর ভারতে হওয়া কৃষক আন্দোলন তাঁদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভোটে পেঁয়াজের ঝাঁজ

মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজের কম দামও নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। রাজ্যটিতে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলাগুলোর একটি বাদে সব কটিতে হেরেছে নরেন্দ্র মোদির দল। তবে বিজেপির এ পরাজয়ে মোটেও হতবাক নন মহারাষ্ট্র পেঁয়াজ উৎপাদনকারীদের সমিতির প্রধান ভারত দিঘোলে।

কয়েক বছর ধরে পেঁয়াজচাষিরা তাঁদের পণ্যের দাম কম পাচ্ছেন। যেমন গত বছরে ৫১২ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করে সর্বনিম্ন ২ রুপি ৯০ পয়সা মুনাফা পেয়েছেন তাঁরা। এ জন্য কৃষকেরা দোষ দিয়েছেন সরকারকে। যেমন গত ডিসেম্বরে পেঁয়াজের দাম যখন কিছুটা বাড়ছিল, তখন রপ্তানি বন্ধ করে দেয় নরেন্দ্র মোদির সরকার। এতে পেঁয়াজের দাম আরও কমে হয় প্রতি কেজি ২২ রুপি।

ভারতে কয়েক বছর ধরে তীব্র সংকটে রয়েছেন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সরকারের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হন কৃষকেরা। তবে তাতে কান দেওয়া হয়নি। নির্বাচনের আগে মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী এলাকাগুলোয় প্রচারণা চালাতে গিয়েছিলেন মোদি। তখন কৃষকদের দুর্দশার বিষয়টি তুলে ধরতে তাঁর সঙ্গে দুই মিনিট দেখা করতে চেয়েছিলেন ভারত দিঘোলে। তাঁর সে আবেদন রাখা হয়নি।

দিঘোলে বলেন, ‘দেখা করতে দেওয়ার বদলে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হলো। আপনি (মোদি) ১০ বছর ধরে আমাদের শাসন করছেন, তবে আমাদের দুই মিনিট দেওয়ার সময়ও আপনার নেই?’ এই আইনজীবীর মতে, কৃষকেরা এবার ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিষয়ের চেয়ে নিজেদের কৃষক পরিচয়কেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর তাঁদের এমন পদক্ষেপ থেকে সুবিধা পেয়েছে কংগ্রেস।

আরও পড়ুন