লাদাখের ডেপসাং ও ডেমচক থেকে চীনা বাহিনীকে কি সরাতে পারবে ভারত

টি-৯০ ও টি-৭২ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী। ১২ আগস্ট, পূর্ব লাদাখ
ছবি: এএনআই

পূর্ব লাদাখের বিভিন্ন এলাকা থেকে সেনা সরানো নিয়ে ভারত ও চীনের সেনা কর্মকর্তারা আজ সোমবার ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরেকবার আলোচনায় বসেছেন। ২০২০ সালের জুনে গালওয়ান সংঘর্ষের পর দুই বাহিনীর মধ্যে এটি ১৯তম বৈঠক। এ আলোচনা শুরু হয় চুসুল সীমান্তে।

ভারতের সরকারি সূত্র অনুযায়ী, আজ বৈঠকে মূলত ডেপসাং ও ডেমচক এলাকা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।

২০২০ সালের সংঘর্ষের পর গত তিন বছরে প্যাংগং, চুমহার, গোগরা হট স্প্রিংয়ের মতো কয়েকটি এলাকা নিয়ে দুই পক্ষে একধরনের সমঝোতা হলেও ডেপসাং ও ডেমচক নিয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এ দুই জায়গা নিয়ে ভারত ও চীন গত ছয়টি বৈঠকে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকেছে। এ অবস্থায় শুরু হয়েছে ১৯তম বৈঠক।

গালওয়ান সংঘর্ষের পর দেখা গিয়েছিল, চীনা ফৌজ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) স্থিতাবস্থা অগ্রাহ্য করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। ভারতের পক্ষে সরকারিভাবে জমি হারানোর কথা স্বীকার করা না হলেও বিরোধীদের শঙ্কা, ওই সংঘর্ষ চীনা ফৌজের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল।

সেই থেকে ভারত বারবার সংঘর্ষ পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে দিতে চীনকে বলে আসছে। অর্থাৎ, ২০২০ সালের জুনের সংঘর্ষের আগে পূর্ব লাদাখে এলএসি যেমন ছিল, সেই অবস্থা মেনে চলতে চীনের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক স্তরে জানিয়ে দিচ্ছে, এলএসিতে স্থিতাবস্থা রক্ষিত না হলে সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হবে না।

কিন্তু চীন ভারতের এই দাবি মানতে নারাজ। এই অনড় মনোভাবের একটা বড় হাতিয়ার ভারতেরই তুলে দেওয়া। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২০ সালের ১৯ জুন গালওয়ান সংঘর্ষ নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘ভারতের জমিতে কেউ (চীনা ফৌজ) বসে নেই, কোনো ভারতীয় ঘাঁটিও কেউ দখল করেনি।’

মোদির কথার অর্থ দাঁড়ায়, এলএসির স্থিতাবস্থা যেমন ছিল, তেমনই আছে। তাহলে সংঘর্ষ–পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি কেন? এ প্রশ্ন বিরোধীরা বারবার তুললেও আজ পর্যন্ত সরকার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। কিন্তু ঘটনা হলো, গত তিন বছরে দুই দেশের সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৮টি বৈঠক হলেও বিবাদ ও বিতর্ক অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওই দাবির এক মাস পর ২৯ জুলাই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয় তো হোক, তবু দেশ সম্পর্কে মিথ্যা বলতে পারব না। ভারতের জমি চীন দখল করে রেখেছে—এই সত্য গোপন করা ও দখলদারদের থাকতে দেওয়া রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সত্য সম্পর্কে দেশকে অবহিত করাই দেশপ্রেম।’

কংগ্রেসের এই অভিযোগের জবাবে শাসক দল বিজেপি ও সরকার বারবার জানিয়েছে, ভারতের ভূখণ্ড চীন দখল করে রেখেছে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় থেকে, কংগ্রেস যখন দেশ শাসন করত।

ডেপসাং ও ডেমচকে চীনা সেনাদের অবস্থান ভারতের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক। এ দুই অঞ্চল থেকে চীনা ফৌজ পিছিয়ে যেতে একেবারেই নারাজ। আবার ভারতও সেখানে বিন্দুমাত্র জমি ছাড়তে চায় না। এর প্রধান কারণ দৌলতবেগ ওলডি সড়ক। লাদাখের এই দুর্গম অঞ্চলে দৌলতবেগ ওলডি পর্যন্ত প্রায় ২২০ কিলোমিটার রাস্তা ভারত তৈরি করেছে।

কারাকোরাম রেঞ্জের উত্তর-পূর্ব কোণে প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায় এই অঞ্চল থেকে চীনের সীমান্ত মাত্র ৪ কিলোমিটার। ওই সড়ক ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘লাইফলাইন’। মুশকিল হলো, সংঘর্ষের পর ডেপসাংয়ে চীনা ফৌজ যেখানে অবস্থান করছে, সেখান থেকে তারা সরে না গেলে এই সড়ক ও ভারতীয় সেনা স্থাপনা তাদের নিশানার মধ্যে চলে আসবে।

ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকে এই সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে চীনও সরে যেতে প্রস্তুত নয়। প্যাংগং, চুমহার, গোগরা হট স্প্রিং প্রভৃতি এলাকায় দুই দেশ সম্মতিক্রমে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ তৈরি করতে পেরেছে। এর অর্থ, মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধবে না—এমন কিছু স্থান নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।

এই বোঝাপড়া যদিও সংঘর্ষ–পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যাওয়া নয়। এর অর্থ, ভারতের যে এলাকা চীন দখল করেছে, সেখানে থেকে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’কে তারা মান্যতা দেবে। বোঝাপড়া অনুযায়ী, ওই চিহ্নিত এলাকায় কোনো দেশের সেনা টহল দেবে না। কিন্তু ডেপসাং ও ডেমচকে তেমন ব্যবস্থায় দুই দেশই এখনো অনড়।

দুই দেশের সেনা কর্তাদের ১৯তম বৈঠক শুরুর আগের দিন গতকাল সরকারি ও সেনা সূত্রে জানানো হয়, গালওয়ান সংঘর্ষের পর পূর্ব লাদাখের চীন সীমান্তে অতিরিক্ত ৬৮ হাজার জওয়ানকে (প্রায় ৭ ডিভিশন) যুদ্ধবিমানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৯০টি ট্যাংক।

প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় এলএসির বিভিন্ন অংশে সেনা ও এসব সমরাস্ত্র মোতায়েন করা হয়েছে। সীমান্তের অন্য ধারে নতুন নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে কি না, সেই নজরদারির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুখোই-৩০ ও জাগুয়ার যুদ্ধবিমান। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের ব্যবস্থাও।

আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের আসার কথা। বহুরাষ্ট্রীয় বৈঠক ছাড়াও সম্মেলনের এক ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা। তার আগে সীমান্ত সমস্যার সুরাহার জন্য ১৯তম বৈঠকে অগ্রগতি হয় কি না, নজর আপাতত সেই দিকে।