হিন্দুধর্মীয় নেতাকে নিয়ে মমতার মন্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিতর্ক

পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে নির্বাচনী প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ ২১ মেছবি: এএনআই

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে ১৭, অর্থাৎ ৪০ শতাংশ আসনে এখনো নির্বাচন বাকি। এ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য ঘিরে রাজ্যের সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনী ইস্যু সামনে চলে এসেছে। পঞ্চম দফা নির্বাচনের দুই দিন আগে গত শনিবার নির্বাচনী জনসভায় মুর্শিদাবাদের এক হিন্দুধর্মীয় নেতাকে সরাসরি আক্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, কার্তিক মহারাজ নামের ওই ব্যক্তি রাজনীতি করছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত রোববার ও গতকাল সোমবার দুটি আলাদা জনসভায় বলেন, হিন্দুসমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘকে পশ্চিমবঙ্গে অপমান করা হচ্ছে।

মোদির বক্তব্যের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানান মমতা। গতকাল সোমবার মুখ্যমন্ত্রী আবার কার্তিক মহারাজের নাম করে বলেন, সব সাধু–সন্ন্যাসী নয়, নির্দিষ্ট ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য রয়েছে।

এরপর গতকাল সন্ধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে চার দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে জবাব চেয়েছেন কার্তিক মহারাজ। এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে বড় ধরনের চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। গত রোববার পঞ্চম দফার ৭ আসনে এ ঘটনার প্রভাব পড়েছে এবং বাকি ১৭ আসনেও পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মমতার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত

গত শনিবার হুগলির গোঘাটে এক নির্বাচনী জনসভায় মমতা বলেন, ‘সব সাধু সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবাই সমান? এই যে বহরমপুরের এক মহারাজ আছেন, কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সংঘকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আমার শ্রদ্ধার তালিকায় তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। কিন্তু এই লোক বলেন, “তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেব না।” ফলে তাঁকে আমি সাধু মনে করি না। কারণ, তিনি সরাসরি রাজনীতি করে দেশের সর্বনাশ করছেন।’

মমতার এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে গত রোববার এবং পরে গতকাল আলাদা জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুসমাজ আক্রান্ত। গতকাল ঝাড়গ্রামের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, হিন্দুসমাজকে অপমান করা হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘকেও তিনি আক্রমণ করেছেন। তৃণমূলের গুন্ডাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জলপাইগুড়িতে গত শনিবার রাতে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম আক্রান্ত হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, ভারতে কেউ কি কখনো ভেবেছিলেন, মিশনের ওপরে হামলা হবে? ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করতে গিয়ে তৃণমূল সেটাই করেছে। রামকৃষ্ণ মিশনের ওপরে আক্রমণ কেউ মেনে নেবেন না।

মমতার পাল্টা প্রতিক্রিয়া

প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য চুপ করে থাকেননি। বরং তিনি কার্তিক মহারাজ বা ভারত সেবাশ্রম সংঘের ওই সদস্য স্বামী প্রদীপ্তানন্দের বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও জোরালো করেন। গতকালই তিনি পাল্টা কার্তিক মহারাজকে আক্রমণ করে বলেন, তিনি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলেননি এবং বলবেনও না।

মমতা বলেন, ‘আমি রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে নই। কয়েক দিন আগেই তো সেখানকার মহারাজ অসুস্থ ছিলেন, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। আমি দু-একজনের সম্পর্কে কথা বলেছি, যাঁদের একজন কার্তিক মহারাজ। তিনি আমাদের এজেন্টকে বসতে দেননি।’

পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রামে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আজ ২১ মে
ছবি: এএনআই

রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড় মঠ ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কতটা ভালো, তার কিছু উদাহরণ দিয়ে মমতা বলেন, ‘ওরা সত্যিই খুব ভালো। আমাকে ভালবাসেন, আর মানুষের জন্য কাজও করেন।’

মন্তব্যের জের

স্বামী প্রদীপ্তানন্দ ওরফে কার্তিক মহারাজ মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে আক্রমণ করে বলেছেন, তিনি তাঁর সম্মানহানি করেছেন। সেই কারণে মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি ভারত সেবাশ্রম সংঘের একজন সন্ন্যাসী। অচেনা কেউ নই। প্রতিষ্ঠিত একজন সন্ন্যাসীর মানহানি করা হয়েছে, তাই আমি আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছি।’

কার্তিক মহারাজ দীর্ঘদিন মুর্শিদাবাদ ও মধ্যপশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠপর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নির্বাচনে বরাবরই তাঁর বড় ভূমিকা থাকে, এবারও ছিল। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হিন্দুত্ববাদী সনাতন ধর্মের পক্ষ নিয়ে নির্দিষ্ট দল বা প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেন।

কার্তিকের রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে অনেকে মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে ভারত সেবাশ্রম সংঘেরও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে।

ভারত সেবাশ্রম সংঘের তরফ থেকে অবশ্য তাদের সদর দপ্তরের মুখ্যসচিব স্বামী বিশ্বোনন্দ বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গরিবদের জন্য কাজ করেন’। কার্তিক মহারাজ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যা বলেছেন, তা বলা উচিত হয়নি। এ মন্তব্য করার জন্য তিনি (কার্তিক মহারাজ) ভারত সেবাশ্রম সংঘের কাছে কোনো অনুমতি চাননি। বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা হবে।

কীভাবে ইস্যু হচ্ছে

কার্তিককে নিয়ে এই বিতর্ক থেমে যাচ্ছে না। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ধর্মীয় শাখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গত শনিবার ষষ্ঠ পর্যায়ের নির্বাচনের আগে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। এ মিছিলে উপস্থিত থাকবেন কার্তিক মহারাজ। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিজেপির অন্য নেতারাও পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতে বিষয়টিকে রাতারাতি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা শুরু করেছেন।

গত রোববার পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে এসে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, ‘ইমামদের উদ্দেশে এমন মন্তব্য করার ক্ষমতা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে? হিন্দু মহন্তরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন বলেই তাঁদের টার্গেট করা হচ্ছে। সাধুসন্তরা রাজনীতি করেন না। কিন্তু আপনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) জানেন, ইমামদের একাংশ চাইলে আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারেন।’

এই বিতর্ক যে আগামী দুই পর্বের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথে নিয়ে যাবে, তা এখন বলাই যায়।