‘ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়ে গেল, খুলে গেছে ভালোবাসার দোকান’

কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জয়লাভের পর দিল্লিতে দলের সদরদপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাহুল গান্ধী। ভারত, ১৩ মে
ছবি: এএনআই

ভারত জোড়ো যাত্রার সময় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বারবার যে কথা বলে এসেছেন, কর্ণাটক জয়ের পর সেই কথারই রেশ টেনে আনলেন তিনি। শনিবার রাহুল বললেন, ‘কর্ণাটকে ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়ে গেল, খুলে গেছে ভালোবাসার দোকান।’

ভারত জোড়ো যাত্রার স্লোগানও ছিল এই রকমই। তামিলনাড়ু থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার হাঁটার সময় বারবার রাহুল বলে এসেছেন, ‘ঘৃণার বাজারে আমি ভালোবাসার দোকান খুলতে এসেছি।’ কর্ণাটক জয় রাহুলের সেই স্লোগান আংশিক সত্য করে দিল। সেই সঙ্গে জোরালো করে তুলল বিজেপির ‘ঘৃণার রাজনীতির’ বিরুদ্ধে তাঁর ও কংগ্রেসের অবস্থান।

শনিবার রাহুল আরও বলেছেন, এটা সত্যের জয়। সেই সত্যের জয়ে উৎফুল্ল তামিল অভিনেতা ও রাজনীতিক কমল হাসান। টুইট করে রাহুলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এই জয়ের জন্য আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন। গান্ধীজির দেখানো পথেই আপনি হাঁটছেন। দেখিয়েছেন, ভালোবাসা ও ভদ্রতা দিয়ে সব জয় করা যায়। আপনার এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। বুক বাজানো নয়। গান্ধীজির মতো আপনিও মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবেন।’ ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুলের সঙ্গে তিনিও হেঁটেছিলেন। কমল হাসান লিখেছেন, ‘কর্ণাটকের জনগণকে আপনি বিশ্বাস করেছেন। বিশ্বাস করে তাদের বিভেদের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে বলেছিলেন। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে। শুধু জয়ের জন্যই আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি না। যেভাবে জয় পেলেন, অভিনন্দন তার জন্যও।’

কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর বেঙ্গালুরুতে কংগ্রেস নেতাকর্মীদের উল্লাস। ভারত, ১৩ মে
ছবি: এএনআই

কর্ণাটকে ‘ঘৃণার বাজার’ খোলা হয়েছিল দেড় বছর আগে। উপকূলবর্তী অঞ্চল, যেখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস বেশি, সেই উদিপি জেলায় শুরু করা হয় হিজাব–বিতর্ক। প্রায় একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে তোলা হয় আজানের সময় মাইক বন্ধের আন্দোলন। হালাল মাংস বিক্রি বন্ধ। মুসলমানদের মাংসের দোকান থেকে হিন্দুদের দূরে রাখতে প্রচার। একই সঙ্গে বিজেপির নেতারা ঘোষণা দেন, এবারের ভোট হতে চলেছে টিপু সুলতানের বংশধরদের (মুসলমান) সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের উত্তরাধিকারের লড়াই।

ধর্মীয় মেরুকরণের শেষ ওখানেই নয়। বারবার রাজ্য সরকার ও বিজেপি চেষ্টা করেছে ধর্মের আধারে ভোট পরিচালনা করতে। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৪ শতাংশ কোটা বন্ধের উদ্দেশ্যও ওই লক্ষ্যে। এমনকি হালে ‘কেরালা স্টোরি’ সিনেমা নিয়ে প্রচারেও বিজেপি খামতি রাখেনি। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রচারে বলেছেন, এই সিনেমার বিরোধিতার মাধ্যমে কংগ্রেস সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিতে চাইছে।

কিন্তু কোনো কিছুই প্রভাব ফেলেনি। প্রধানমন্ত্রী তাই অহেতুক কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন। মল্লিকার্জুন খাড়গের মন্তব্য তুলে প্রচার করেছেন যে তাঁকে ‘বিষধর সাপ’ বলা হয়েছে। পরদিনই জনসভায় তাঁর দাবি, কংগ্রেস তাঁকে ৯১ বার অপমান করেছে। কংগ্রেসের ইশতেহারে বজরঙ্গ দলের প্রসঙ্গ টেনে বজরঙ্গবলীকে (হিন্দুদের ভগবান হনুমান) অপমান করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে। দিকে দিকে বিজেপি নেতা–সমর্থকেরা হনুমান চালিশা পাঠ শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ‘জয় হিন্দ’ বা ‘ভারতমাতা কি জয়’–এর বদলে ভাষণ শেষে দিতে থাকেন ‘জয় বজরঙ্গবলী’ স্লোগান। এমনকি সোনিয়া গান্ধীর ভাষণ থেকে ‘সার্বভৌম’ শব্দটি তুলে ধরে প্রচার করতে থাকেন কংগ্রেস কর্ণাটককে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। অথচ কোনো কিছুই কাজে এল না। উত্তর ভারতে যে তত্ত্ব সাফল্য এনে দিয়েছে, বহুত্ববাদী ভারতে তা যে সর্বত্র প্রযোজ্য নয়, কর্ণাটক বিধানসভার ফল তার প্রমাণ দিল।

কংগ্রেস আগেই ঘোষণা করেছে, এবার অরুণাচল প্রদেশ থেকে গুজরাট পর্যন্ত পূর্ব–পশ্চিমে ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু করবে। কর্ণাটকের সাফল্য কংগ্রেসকে ‘ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান খুলতে’ রাহুল গান্ধীকে নিশ্চিতভাবেই উদ্বুদ্ধ করবে। শনিবার রাহুল সম্ভবত সেই ইঙ্গিতই দিয়ে রাখলেন।