মোদি-আরএসএস দূরত্ব বেড়ে চলেছে, বিজেপি সভাপতির ইঙ্গিত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গতকাল মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেনছবি: এএনআই

নির্বাচন চলাকালীন বিজেপি সভাপতি জগৎ প্রকাশ (জেপি) নাড্ডার কিছু মন্তব্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে শাসক দলের সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। দূরত্ব বেড়েছে।

নাড্ডার ওই মন্তব্য নিয়ে আরএসএস যেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি, তেমনই বিজেপি থেকেও নতুন কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। আগামী দিনে দুই সংগঠনের সম্পর্ক কোন দিকে এগোবে, তা নির্ভর করছে লোকসভা নির্বাচনের ফলের ওপর।

পঞ্চম দফার ভোটের ঠিক আগে বিজেপি সভাপতি নাড্ডা সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে সাক্ষাৎকার দেন। অটল বিহারি বাজপেয়ীর আমল থেকে শুরু করে এ সময়ে সংঘের ভূমিকায় কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না, তা জানতে চাওয়া হলে নাড্ডা বলেন, ‘আগে আমরা (বিজেপি) অক্ষম ছিলাম। ছোট (দল হিসেবে) ছিলাম। তাই তখন আরএসএসের প্রয়োজন ছিল। এখন আমরা অনেক বড় হয়ে গেছি। পুরোপুরি সক্ষম। বিজেপি এখন নিজের শক্তিতেই চলতে শিখেছে।’

এই উত্তরের পিঠে নাড্ডার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তা হলে কি ধরে নিতে হবে—বিজেপির এখন আরএসএসকে প্রয়োজন নেই? জবাবে নাড্ডা বলেছেন, ‘প্রশ্নটা প্রয়োজনের নয়। দল এখন অনেক বড় হয়েছে। প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত, সচেতনও। আরএসএস সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন, বিজেপি রাজনৈতিক। ওরা আদর্শ অনুযায়ী ওদের কাজ করে। আমরা আমাদের কাজ করি। আমরা আমাদের দায়িত্ব নিজেদের মতো করে পালন করছি। রাজনৈতিক দলের সেটাই করা উচিত।’

বিজেপি ও আরএসএস একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল ও পরিপূরক বলে যে ধারণা এত দিন পর্যন্ত ছিল, এই সাক্ষাৎকার তা পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিল। নাড্ডার কথার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, বিজেপির ভালোমন্দ এখন তারাই ঠিক করতে পারে। নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে। আরএসএসের হাত বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। যে ভঙ্গিতে নাড্ডা এই কথাগুলো বলেছেন, তাতে পরিষ্কার, দল ও সরকার পরিচালনাকে কেন্দ্র করে সংঘের সঙ্গে বিজেপির মতপার্থক্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যবধান এতটাই বেড়ে গেছে যে বিজেপি এখন সংঘের কোনো ভূমিকাই গ্রহণযোগ্য মনে করছে না।

বিজেপি সভাপতির কথা থেকে এটাও স্পষ্ট, এতকাল আরএসএস ছিল যন্ত্রী, বিজেপি যন্ত্র। এখন বিজেপিই সর্বেসর্বা। নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা। আরএসএস বাহুল্যমাত্র।

আগামী বছর আরএসএস শতবর্ষে পা দেবে। সেই সন্ধিক্ষণে নাড্ডার এ মন্তব্যের কার্যকারণ নিয়ে নানা মহলে নানা অভিমত শোনা যাচ্ছে। অধিকাংশের ধারণা, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি ক্রমে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন যে দল ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অন্য কারও পরামর্শের প্রয়োজন অনুভব করছেন না। তাঁর সাফল্য যে পুরোপুরি তাঁরই, সেটাই তিনি প্রতিপন্ন করতে চান। সেই সাফল্যের ভাগীদার আর কাউকে হতে দিতে তিনি চান না। তাই সংঘের ভূমিকাকে তিনি এভাবে অস্বীকার করতে পারছেন।

এ ধারণার কারণ, তাঁর মনোনীত সভাপতি সংঘ ও বিজেপির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার কোনো প্রতিবাদ বা সংযোজন প্রধানমন্ত্রী দেননি। ফলে মনে করা হচ্ছে, মোদি যা জানাতে চান, যে বার্তা তিনি সংঘ ও অন্যদের দিতে চান, তা তিনি নাড্ডা মারফত জানিয়ে দিলেন। এর মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, দল ও সরকারকে নিজের মতো করে চালাতে তিনি সক্ষম। এভাবে চালিয়েই তিনি সফল হয়েছেন। এভাবেই চলবেন। সংঘের পরামর্শ তাই অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয়।

প্রশ্ন হলো, নির্বাচন যখন চলছে, তখন সংঘকে এ বার্তা নরেন্দ্র মোদি কেন দিতে গেলেন?

সাংবাদিক ও লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় এই ‘মোদি মানসিকতার’ একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘নরেন্দ্র মোদি: দ্য ম্যান, দ্য টাইমস’ ও ‘দ্য আরএসএস: আইকনস অব দ্য ইন্ডিয়ান রাইটস’–এর লেখক আজ বুধবার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘ ও বিজেপির সম্পর্ক নিয়ে এমন মন্তব্য কেউ কোনো দিন করেননি। তাই চমকে গিয়েছিলাম। চার দিন হয়ে গেল এ নিয়ে বিজেপির সর্বেসর্বা (মোদি) কোনো মন্তব্যও করেননি। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নাড্ডার এ মন্তব্য আলটপকা নয়। তিনি যা বলেছেন, তা মোদিরই কথা। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, আরএসএস-বিজেপি সম্পর্কে কোথাও একটা বড়সড় বদল ঘটে গেছে।’

নীলাঞ্জন বলেন, বাজপেয়ীর সময়েও বিজেপির পরিচালনায় আরএসএস বড় ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি ২০১৩ সালে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর সংঘ যখন মোদিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখ হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনো সেই ভূমিকা অটুট ছিল। কিন্তু মোদি ধীরে ধীরে প্রথমে দলে একাধিপত্য স্থাপন করলেন, পরে সংঘের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে দিলেন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন দেশ, সরকার ও দলের নিয়ন্তা। দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে উপেক্ষা করতে লাগলেন সংঘের যাবতীয় নির্দেশ।

নীলাঞ্জনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আরএসএস কখনো ব্যক্তিপূজার পক্ষপাতী নয়। আদর্শচ্যুতিও তাদের ঘোর অপছন্দ। দুটি ক্ষেত্রেই মোদি নিজেকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছেন। নিজেকে তিনি সংগঠনের চেয়ে বড় মনে করছেন। গড়ে তুলেছেন ‘পারসোনালিটি কাল্ট’। সরকারে টিকে থাকার জন্য আদর্শের বালাই না রেখে তিনি যথেচ্ছভাবে দল বাড়িয়ে গিয়েছেন। এবারের ভোটে বিজেপি যতজনকে প্রার্থী করেছে, তার এক–তৃতীয়াংশ অন্য দল থেকে যোগ দেওয়া। ওই প্রার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ আবার কংগ্রেসি, যে দলের সঙ্গে আরএসএসের লড়াই আদর্শগত। নীলাঞ্জন মনে করেন, এ কারণে এবার নির্বাচনী প্রচারে সংঘ সেভাবে সক্রিয় হয়নি। যে প্রার্থীরা শুরু থেকেই সংঘের আদর্শে দীক্ষিত, যেমন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষ কিংবা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি ও রাজনাথ সিং, তেমন কিছু হাতে গোনা প্রার্থী ছাড়া আরএসএসকে এবার প্রচারে দেখা যাচ্ছে না।

সেটাই সম্ভবত মোদির ক্ষোভ ও অভিমানের কারণ। আর এ কারণেই নাড্ডা মারফত এ বার্তা দিয়ে মোদি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন, সংঘ সক্রিয় না হলেও তিনি সরকার গড়বেন। তিন শতাধিক আসন জিতে হ্যাটট্রিক করবেন। নীলাঞ্জনের কথায়, মনে হয়, নাড্ডাকে দিয়ে ওই কথা বলিয়ে মোদি তাঁর ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, সংঘ গা ঝাড়া না দিলেও আরও একবার তাঁর ক্ষমতাসীন হওয়া আটকাবে না। সংঘকে বলতে চেয়েছেন, ‘তোমরা মাঠে নামনি, তবু আমি জিতব।’

বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের আদর্শগত এ সংঘাত আরও বাড়বে মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে। নীলাঞ্জন মনে করেন, কিন্তু কোনোভাবে ২৭২ ম্যাজিক ফিগারের কাছাকাছি গিয়ে বিজেপি যদি থমকে যায়, আরএসএসের কাছে তখন নরেন্দ্র মোদিকে নতজানু হতে হবে। রাজনীতির প্রবাহ তখন অন্য খাতে বইবে।