যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া: সব পক্ষকে কেন হাতে রাখতে চায় ভারত

গত সপ্তাহে ভারত সফরে গিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে একসঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের জন্য কেমন চ্যালেঞ্জের, তা নিয়ে গালফ নিউজে লিখেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক নিধি রাজদান। গালফ নিউজের অনলাইন সংস্করণে ৭ ডিসেম্বর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে।

নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বৈঠকের পর পুতিন ও মোদি। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি সফরে নয়াদিল্লি ঘুরে গেলেন। তিনি যে সময়ে ভারতে সফরে এলেন, সময়টি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এটিই ছিল পুতিনের প্রথম ভারত সফর।

ভারত বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে কঠিন আলোচনার মধ্যে রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত আশা করছে, রাশিয়ার তেল কেনার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের ওপর যে কঠোর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তা বাতিল হবে। ভারতের ওপর মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এখন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে, সেসব দেশের অন্যতম হচ্ছে ভারত।

রাশিয়ার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ওয়াশিংটনকে খুশি করতে ভারত মস্কো থেকে তেল কেনা কমানো শুরু করেছে। কিন্তু পুতিনকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়ার মাধ্যমে এই বার্তাও দেওয়া হয়েছে, ভারতের কাছে বিকল্প রয়েছে। তারা সহজে পুরোনো বন্ধুকে পরিত্যাগ করবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিমানবন্দরে ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানানোর ঘটনায় এই বার্তা স্পষ্ট।

দৃঢ় সম্পর্ক

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহু দশকের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য গত কয়েক বছরে রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা কিছুটা কমেছে। তবু মস্কো এখনো ভারতের প্রধান প্রতিরক্ষা সরবরাহকারী।

চলতি বছরের মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে নয়াদিল্লি দাবি করে থাকে।

হায়দরাবাদ হাউসে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন দুই নেতা। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
ছবি: এএফপি

অন্যদিকে নয়াদিল্লি পশ্চিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক প্রসারিত করেছে। এ সময়ে মস্কোও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবু ভারত-রাশিয়া বন্ধুত্ব মোটামুটি মজবুত রয়ে গেছে।

ঠিক এ কারণেই এই সময়ে পুতিনের নয়াদিল্লি সফর এ বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করছে, ভারত নির্দিষ্ট কোনো ‘গোষ্ঠীর’ দিকে ঝুঁকে যেতে প্রস্তুত নয়। সম্পূর্ণভাবে নিজের স্বার্থের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখবে।

ঝুঁকির মধ্যে হাঁটা

তবে বলা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয়। পুতিনের সফর এই বাস্তবতাও তুলে ধরেছে, নয়াদিল্লির বর্তমান ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল কতটা কঠিন। ওয়াশিংটনের সঙ্গে সূক্ষ্ম আলোচনার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গেও দিল্লির শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে।

পুতিনের সফরের ঠিক আগে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের সমালোচনা করে ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতদের লেখা একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই লেখা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিব্রত করেছে। তারা এই লেখাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে নয়াদিল্লির আমন্ত্রণ জানানোর সমালোচনা হিসেবে দেখেছিল।

তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের নিজস্ব যোগাযোগ এবং দ্রুত একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার বিষয়টি বিবেচনা করে ভারত সরকার এ বিষয়ে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

হায়দরাবাদ হাউসে সংবাদ সম্মেলনের পর করমর্দন করেন পুতিন–মোদি। ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
ছবি: এএফপি

ভারত ও রাশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার কোটি ডলার বাণিজ্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে ভারতকে রাশিয়ার তেল কেনা কমাতে হচ্ছে। এর ফলে সেই লক্ষ্য অর্জন করা আরও কঠিন হবে।

ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার নিঃসন্দেহে অনন্য এক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত যদি প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তিচুক্তি চূড়ান্ত করতে উৎসাহিত করতে পারে, তবে তা ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় জোর দিয়ে বলেছিলেন, ভারত ‘নিরপেক্ষ’ নয়, বরং শান্তির পক্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রোলার কোস্টার সম্পর্ক

তবে চলতি বছর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে রোলার কোস্টার সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে, তা কেবল এটাই প্রমাণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নির্ভরযোগ্য বন্ধু নয়। যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে সেটা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় এই সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি হলেও আস্থা পুনরুদ্ধার করতে অনেক সময় লাগবে।

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের জোট ‘কোয়াড’ বিগত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু শত্রু–বন্ধুনির্বিশেষে সবার প্রতি ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক মনোভাবের কারণে পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।

ভারতের বিমানবাহিনীর পালাম ঘাঁটিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে স্বাগত জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এরপরে এক গাড়িতে চড়ে যাত্রা করেন তাঁরা। ৪ ডিসেম্বর ২০২৫, নয়াদিল্লি
ছবি: এএফপি

ওয়াশিংটনের দ্বিমুখী নীতি আবারও স্পষ্ট। ট্রাম্পের জন্য পুতিনের সঙ্গে দেখা করা ঠিক। যেমনটি তিনি আলাস্কায় করেছিলেন। কিন্তু মোদির জন্য পুতিনের সঙ্গে দেখা করা যেন ঠিক নয়।

দীর্ঘ মেয়াদে ভারতকে তার প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে একদিকে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এবং অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। ভারতকে সব ডিম যুক্তরাষ্ট্রের ঝুড়িতে রাখা কখনোই একটি বিকল্প ছিল না এবং হওয়াও উচিত নয়।