হারের ভয়েই কি কাশ্মীরে প্রার্থী দিল না বিজেপি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে দাবি করছেন, কাশ্মীরে বিদ্রোহ দমন করে শান্তি ফিরিয়ে আনা তাঁর সরকারের এক বিরাট অর্জন। কিন্তু বিতর্কিত এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, মোদির এই বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরা যে একেবারেই একমত নন, সেটা জানানোর সুযোগ এসেছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে।
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের হাওয়া যখন থেকে বইতে শুরু করেছে, তখন থেকেই একটা ধারণা ছিল, মোদির বিজেপি এবারের নির্বাচনে টানা বড় জয় পেতে যাচ্ছে। তবে এই দলটি তিন দশকের মধ্যে এবারই প্রথম কাশ্মীরের তিন আসনের কোথাও কোনো প্রার্থী দেয়নি। শুধু হিন্দু–অধ্যুষিত জম্মুর দুই আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছে। রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, যদি তারা কাশ্মীরে প্রার্থী দিত, তাহলে তাদের নিদারুণ পরাজয় হতো।
মোদির সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন–সংবলিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এই পদক্ষেপ নেওয়ার পর কাশ্মীরে ব্যাপক ক্ষোভ–বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে, রাজ্যের সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে এবং কয়েক মাস ধরে টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রাখে।
৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলকে কেন্দ্র করে সরকার দমনপীড়ন শুরু করলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলে সহিংসতা কমে যায়। বিজেপি প্রতিনিয়ত দাবি করছে, সহিংসতা কমে যাওয়া এই ইঙ্গিত দেয় যে রাজ্যের বাসিন্দারা তাদের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পদক্ষেপকে সমর্থন দিচ্ছে।
তবে কাশ্মীরের ভোটারদের বড় একটি অংশ তাঁদের অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পদক্ষেপে যে কতটা হতাশ, এবারের নির্বাচনে তার জবাব দিতে মুখিয়ে আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাশ্মীরের শ্রীনগরের মধ্যবয়সী এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি অতীতে কখনো ভোট দিইনি। তবে এবার আমি ভোট দেব। আমি দেখাতে চাই, ভারত সরকার আমাদের সঙ্গে যা করেছে, তাতে আমি মোটেই খুশি নই।’
ওই ব্যক্তি বলছিলেন, ‘ভারত কীভাবে বলতে পারে, কাশ্মীরের মানুষ তাদের পদক্ষেপে খুশি? আসলে ভয় ও দুর্দশার মধ্যে আমাদের দমবন্ধ অবস্থা এখন।’
একমত নন কাশ্মীরের মানুষ
১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর কাশ্মীরও ভাগ হয়ে যায়। দুই দেশই পুরো কাশ্মীরকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে। হিমালয়ের এই অঞ্চল নিয়ে তাদের মধ্যে দুই দফা যুদ্ধও হয়ে গেছে।
কাশ্মীরের বিদ্রোহীরা নয়াদিল্লির শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে ১৯৮৯ সাল থেকে ভারতশাসিত কাশ্মীরে লড়াই চালিয়ে আসছে। তারা হয় স্বাধীনতা নয়তো পাকিস্তানের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়।
কয়েক দশকের সংঘাতে ভারতের সেনা সদস্য, বিদ্রোহী ও বেসামরিক নাগরিক মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত মাসেও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারতে গত ১৯ এপ্রিল সাত দফার লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। ছয় সপ্তাহব্যাপী এই নির্বাচন শেষ হবে ১ জুন। ৪ জুন ফল ঘোষণা করা হবে।
নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর মন্ত্রীরা কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিষয়ে বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বলে চলেছেন, তাঁরা কাশ্মীরে ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ ফিরিয়ে এনেছেন। ভারতের যেকোনো জায়গার ভোটার তাদের এই নীতিকে সমর্থন করছেন।
কিন্তু নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘন দিন দিন বাড়তে থাকায় এই উপত্যকার বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে উতর–চাপান লক্ষ করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে, প্রতিবাদ–বিক্ষোভের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে।
সংবিধান অনুযায়ী, এত দিন স্থানীয় চাকরি ও ভূমির ওপর কাশ্মীরের মানুষের অধিকার সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত তাঁদের সেই অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে। এতে এই অঞ্চলের মানুষ হতাশ।
ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবিতে প্রকাশ্যে প্রচার চালানো বেআইনি। দিল্লির সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে নাকি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন চাইবে—তা নিয়ে কাশ্মীরের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল বেশ মতভিন্নতা রয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মীরের শ্রীনগর–পুলওয়ামা আসনের প্রার্থী ওয়াহিদ উর রহমান পারা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রতি বিরোধিতার ক্ষেত্রে কাশ্মীরের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়েছে।
পারা বলছিলেন, দলমত নির্বিশেষে আজ কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে বিশাল সংহতি তৈরি হয়েছে।
পারার দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত বিজেপির মিত্র ছিল। এখন এই দলটি কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে আনার দাবিতে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
পারা বলেন, ভোটাররা ‘দিল্লিকে এই বার্তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত যে কাশ্মীর নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখানকার জনগণের সম্মতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি অবশ্যই এখানকার জনগণের মতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।
‘প্রতিটি হৃদয় জয় করতে চাই’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিক সিদ্দিক ওয়াহিদ বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, এই অঞ্চল নিয়ে মোদি সরকারের নীতির ব্যাপারে এবারের লোকসভা নির্বাচনকে ‘গণভোট’ হিসেবে দেখছে কাশ্মীরের জনগণ।
সিদ্দিক বলেন, ‘বিজেপি কেন এখানে কোনো প্রার্থী দেয়নি, সেটা খুবই পরিষ্কার। কারণ, তারা জানে, তারা হারবে। আসল ঘটনা হচ্ছে এটাই।’
মোদির দল ভারী বাংকার আর শ্রীনগরের বেশির ভাগ সরকারি অফিস খালি রাখার মাধ্যমে কাশ্মীরে তাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে।
পাঁচ লাখের বেশি সেনা স্থায়ীভাবে এই অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। আধা সামরিক বাহিনীর অব্যাহত উপস্থিতি এই অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিজেপি কাশ্মীরের বড় ও পুরোনো দলগুলোর বদলে মোদির নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে গড়ে উঠা নতুন ছোট ছোট দলকে ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মোদির ঘনিষ্ঠ ভারতের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত মাসে এক জনসভায় বলেছেন, তাঁদের দল কৌশলগত কারণে কাশ্মীরে প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অমিত শাহ বলেন, তিনি ও তাঁর মিত্ররা কাশ্মীরে ‘পদ্মফুলের বিকাশে’ তড়িগড়ি করবেন না। বরং উপত্যকার মানুষকে তাঁদের ভালো কাজ সম্পর্কে বোঝাতে তাঁরা ধীরে এগোতে চান। পদ্ম হচ্ছে বিজেপির দলীয় প্রতীক।
জনসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কাশ্মীর জয় করতে যাচ্ছি না। আমরা কাশ্মীরের প্রতিটি মানুষের হৃদয় জয় করতে চাই।’