বিশেষ সাক্ষাৎকার

বিরোধীদের হেনস্তা করতে দুর্নীতি বড় অজুহাত: অমর্ত্য সেন

ভারতের রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষাচর্চা, ইতিহাস পরিবর্তনের চেষ্টা, বাংলাদেশ প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। শান্তিনিকেতনে অমর্ত্য সেনের বাড়িতে এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কলকাতার প্রতীচী ইনস্টিটিউটের জাতীয় গবেষণা সমন্বয়ক সাবির আহমেদপ্রথম আলোর পূর্ব ভারত সংবাদদাতা শুভজিৎ বাগচী

অমর্ত্য সেন, সম্প্রতি শান্তিনিকেতনের বাড়িতে
ছবি: শুভজিৎ বাগচী
প্রশ্ন:

এ অঞ্চলের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই সময় দাঁড়িয়ে এ অঞ্চলের প্রধান তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার কী মনে হচ্ছে?

অমর্ত্য সেন: ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সবারই নানান রকম সমস্যা আছে। এ বিষয়ে আমাদের ওয়াকিব না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে পার্থক্যগুলো বিভিন্ন। একদিকে রাজনৈতিক চিন্তাধারার যে দমন হয়েছে, সেটা হয়তো ভারতবর্ষে ক্রমেই বাড়ছে, আগে সেটা হয়তো ছিল না বা তুলনায় কম ছিল।

একটা পার্থক্য হচ্ছে যে বাংলাদেশে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে আমরা দেখছি যে গরিবদের দিকে নজর দেওয়ার একটা বড় রকম প্রচেষ্টা আছে। এটা ভারতে নেই, পাকিস্তানেও নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশে কিছু বড় জিনিস আছে, এখান থেকে ভারত বা পাকিস্তানের হয়তো শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। নানা দিক দিয়েই বিষয়টার তুলনা করা যায়। তবে ভারতে রাজনৈতিক চর্চা যতটা সম্ভব ছিল, বাংলাদেশে হয়তো তার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ক্রমেই হয়তো সেটা কমে আসছে।

ভারতেও চিন্তাধারার একটা সামান্যতা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, এটা আমাদের মানতেই হবে। ভারতবর্ষে যেটা আগে ছিল, বলা যায়... গরিবদের প্রতি খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও খানিকটা মানবিক কর্তব্য এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটা চেষ্টা ছিল। সেই সক্ষমতাটা কমছে। ভারতে গরিবদের প্রতি নজর দেওয়াটা তার ফলে বাড়ছে, এমনটা বলা যাবে না। যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেই পরিবর্তনগুলোকে তাই সমর্থন করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে অনেক উন্নতি করেছে। তবে গত এক বছরে তারা নানা অর্থনৈতিক সমস্যারও মুখোমুখি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কমা বা ঋণের অত্যধিক বোঝা ইত্যাদি অর্থনীতির ভাষায় যাকে ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটর বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রে সেসব দুর্বল হয়ে পড়ছে। আবার ভারতের ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটর, যেমন পাইকারি বাজার বা জমি-বাড়ির দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। আপনি কি বলবেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত খারাপ হয়েছে এবং ভারতের অবস্থা যতটা খারাপ বলে মনে করা হচ্ছে, ততটা নয়?

অমর্ত্য সেন: আপনি যেটা বললেন, সেটার মধ্যে সত্যতা আছে। কিন্তু সেটাকেই ধ্রুব সত্য বলে মানা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য যে বাংলাদেশে সমস্যা কিছু কিছু আছে ঠিকই, আপনি যেমনটা বললেন। তা সত্ত্বেও নানা দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে আসতে পেরেছে; তাদের সমস্যাগুলোকে একটা রূপ দিতে পেরেছে। এই রূপটা যে সব সময় নিম্নমুখী, তেমনটা নয়। অন্যদিকে ভারতে তো একসময় নানা জিনিস করা হয়েছে। এমনকি গান্ধীর চিন্তাধারার একটা প্রভাবও ভারতে ছিল। সেটা তো ক্রমেই কমছে বলেই মনে হচ্ছে।

ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটরের বিষয়ে আমি বলতে পারব না। তবে ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটর নানা দিক থেকে বিচার করা যায়। কতগুলো প্রধান বিষয় আছে। যেমন ধরা যাক, মেয়েরা কী খাওয়াদাওয়া করছে বা ঠিকমতো করতে পারছে, শিক্ষাচর্চা কেমন হচ্ছে, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কেমন বা চাকরির জন্য অন্যত্র যাওয়ার সক্ষমতা কেমন রয়েছে—এ ধরনের নানা প্রশ্ন করা যায়। এসব বিষয়ের দিকে তাকিয়ে যদি বিচার করা যায়, তাহলে ম্যাক্রো ইকোনমিক ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক ভালো করেছে, এটা আমি বলতে পারি না।

নোবলবিজয়ী অমর্ত্য সেন
প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রশ্ন:

ভারতকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র বলা হয়। কিন্তু এটা তো এখন প্রায় সর্বত্রই বলা হচ্ছে যে এখানে মতপ্রকাশের বা সংখ্যালঘুদের অধিকার কমছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? মতপ্রকাশের অধিকার কি এখানে আগের চেয়ে সংকুচিত হচ্ছে?

অমর্ত্য সেন: এটাকে নানাভাবে দেখা যায়। বাংলাদেশে নানান সমস্যা ছিল গোড়াপত্তনের সময় থেকে। সাম্প্রদায়িকতা একটা বড় সমস্যা। এখন সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একটা বড় উপলব্ধি আছে। ভারতবর্ষে এই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে অবস্থাটা বাংলাদেশের চেয়ে এই সময়ে অনেক খারাপ।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

ভারতবর্ষে অনেক খারাপ?

অমর্ত্য সেন: খুবই খারাপ। কিছু লোক যা মনে করেন তা বলার সুযোগ পাচ্ছেন, কিন্তু সেটাকে কি স্বাধীনতা বলা যায়? কিছু লোক, তাঁরা যা মনে করেন তা বলার সুযোগ পাচ্ছেন।...তাঁদের কথার হয়তো দাম আছে। কিন্তু সেটাকে কি স্বাধীনতা বলা যায়? কোনো সন্দেহ নেই যে সামগ্রিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে।

আমার পরিচিত একটি ছাত্রী আছে, সে বলে, ‘আপনি যা লেখেন, পড়লে মনে হয় এবার বোধ হয় (ইতিবাচক) কিছু একটা ঘটবে। তারপর দেখি আবার সবকিছু সেই আগে যেমন ছিল (তেমনই চলছে)। এরা আবার সেই রকমভাবেই চালাচ্ছে। আপনাকে একেবারে পাত্তা দিচ্ছে না, এটা ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু তুচ্ছ করছে।’ (হেসে) এই যে হিন্দুত্ববাদের প্রশ্নে পার্থক্য করা, এটা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন
ছবিটি টুইটার থেকে নেওয়া
প্রশ্ন:

আমরা লক্ষ করছি যে ইতিহাস পরিবর্তন হচ্ছে। ইতিহাসের বই থেকে মোগলদের সরিয়ে দেওয়া, রাস্তার নাম পরিবর্তন করা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে পাঠ্যবই থেকে তুলে নেওয়া—এ ধরনের ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটছে। আবার পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে লেখা বই হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনাজাতীয় বিষয় পাঠ্যসূচিতে স্থান করে দেওয়া হচ্ছে...

অমর্ত্য সেন: কিছু কিছু ভালো জিনিস ঘটছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রচেষ্টাও যথেষ্ট আছে ঠিকই। কিন্তু এর মধ্যেই আবার চিন্তার অভাবও প্রকট। যেমন মোগলরা যখন এল, তখন যে হিন্দু রাজারা ছিলেন, তাঁরা মোগলদের পিটিয়ে একেবারে সাফ করে দিলেন এবং জিতে গেলেন। (হেসে) কিন্তু এ রকমটা তো ঘটেনি। একেবারেই ঘটেনি। এখন এ রকমটা যদি বলা হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের কী ধরনের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে, তা নিয়ে তো খুবই চিন্তা করতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা তো একেবারেই ভুল কথা শিখছে।

প্রশ্ন:

আপনার এবং ক্ষিতিমোহন সেনের বইয়ে আছে, মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারা শিকো সংস্কৃত শিখে উপনিষদ অনুবাদ করেছেন। পাশ্চাত্যে হিন্দু দর্শনের চর্চায় তাঁর প্রভাব গভীর। এটাই ভারতের ইতিহাস। ইতিহাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারতের এই বৈচিত্র্য ক্রমেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দি-হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছে, আর তা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব প্রান্তে। এর উল্টো প্রতিক্রিয়ায় আবার উত্থান ঘটছে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অমর্ত্য সেন: অবশ্যই একটা বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ, ভারতবর্ষে নানা ধরনের মানুষ ছিলেন এবং আছেন। আমাদের যাঁরা রাজত্ব করেছেন, তাঁরা এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেছেন। দারা শিকো, যাঁর কথা আপনি বললেন, তিনি তো এসব বিষয় নিয়ে অনেক ভেবেছেন। তিনি হিন্দুধর্ম বিদেশে প্রচার করলেন। তাঁর মায়ের স্মৃতিতে ভারতের সবচেয়ে সুন্দর এবং দর্শনীয় স্মারক (তাজমহল) তৈরি হলো। তাঁর (দারা শিকো) মধ্যে নানা রকম চিন্তাভাবনা আমরা দেখতে পাই। তিনি প্রচণ্ড চেষ্টা করেছিলেন।...সে যুগে বৃহত্তর পৃথিবী যেটা, সেখানে ফারসির চল ছিল। ইরানিরা যা অনুবাদ করতেন, তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত। সেই বৃহত্তর পৃথিবীতে হিন্দুধর্মের বইগুলোকে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। ফলে সংস্কৃত থেকে দারা শিকোর অনুবাদ ইরানিয়ান এবং সেখান থেকে জার্মান—এইভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু এটা একটা অত্যন্ত জটিল বিষয়। এখন তা আলোচনা করার যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে নেই। এটা ঠিকই যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ওপর ট্যাক্স চাপিয়েছেন। কিন্তু এ যুগে যে হিন্দুদের ট্যাক্স দেওয়াটা একটা প্রচণ্ড বড় ঘটনা, এটা বোধ হয় আর বলা যাবে না। (হেসে) এখন আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা তো থাকে না। যেমন ক্লাইভ যখন সিরাজউদ্দৌলাকে বললেন, তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কারা। তিনি যাঁদের নাম করলেন, তাঁরা সবাই হিন্দু। অনেকেই হিন্দু জমিদার। এঁদের সঙ্গে সিরাজের কোনোরকম শত্রুতা তো ছিল না।

প্রশ্ন:

এরপর ইংরেজদের সময়ে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কটা কেমন দাঁড়িয়েছিল?

অমর্ত্য সেন: মুসলমানদের রাজত্বে ইংরেজরা যখন পারমান্যান্ট সেটেলমেন্ট (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) করলেন, তখন তার সুবিধা পেল হিন্দুরা। প্রশ্ন হলো যে এটা কী করে হতে পারে? এটা যদি মুসলমানপ্রধান দেশই হয়, তাহলে সে সময় জোরটা তো থাকার কথা মুসলমান রাজাদের। উত্তর হলো এই যে মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ দিতে হবে, এই কথাটা মুসলমান রাজারা একেবারেই ভাবেননি। অনেক (হিন্দু) রাজা ছিলেন এবং এসব লোক সুবিধা পেয়েছেন মুসলমানদের রাজত্ব থাকাকালীনই। এটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এই জিনিসটা লোকেরা অনেক সময় ‘মিস’ করে যায়। এটা কী করে হলো? কী করে সম্ভব? সম্ভব এ কারণেই যে মুসলমান রাজাদের এমন একটা বড় ইচ্ছার মধ্যে পড়েনি যে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের থেকে ভালো করুক।

এর ফলে যাদের সুবিধা হলো, তারা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু। এই জিনিসটা বলা খুব দরকার। কারণ, আমাদের দেশে এটা প্রায়ই বলা হচ্ছে যে মুসলমানরা এসে আমাদের—ওই যে কী নাম ওই হিন্দু লেখকের যিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে এলেন এবং বললেন হিন্দুরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—তিনি এই কথাটা বলতে থাকলেন। সেটা আমি উদ্ধৃতও করেছি। (তিনি বললেন যে) মুসলমানদের আস্ফালন শুরু হওয়ার পর আর কোনো হিন্দু মন্দির তৈরি হয়নি, কোনো হিন্দু প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি। হিন্দুধর্ম তখন একেবারে নিচের দিকে চলে গেল। এসব একেবারে বাজে কথা। হ্যাঁ, নামটা মনে পড়েছে। এটা বলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আগত বিখ্যাত লেখক ভি এস নাইপল। এসব হচ্ছে নাইপলের কথা। (হেসে) তিনি আবার এক পাকিস্তানি মেয়েকে বিয়ে করলেন, যিনি আবার আমার বিশেষ বন্ধু। (প্রবল হাসি) এটা এখানে ভাবা দরকার যে একটা দেশ তার বিভিন্নতা নিয়ে চলে। তার মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতের লোক থাকেন।

প্রশ্ন:

ফেডারেলিজমের প্রশ্নে ভারতে বর্তমানে আমরা দুটি জিনিস দেখতে পাচ্ছি। একটা রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা, আরেকটা অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতা। রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতার একটা ধারা হলো বিরোধীদের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকতে হবে। মহারাষ্ট্রের এনসিপি দলের বিরোধী নেতা অজিত পাওয়ার সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। পরে হয়তো দেখা যাবে সেই মামলা নিয়ে আর কোনো কথা হচ্ছে না। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। অন্যদিকে আছে অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতা। এসব উত্তরোত্তর বাড়ছে। এর ভবিষ্যৎ কী?

অমর্ত্য সেন: আমরা ভারতবর্ষকে এক দেশ হিসেবে দেখলে বিভিন্ন অঞ্চলের যে স্বাধীনতা থাকার কথা, সেটা কতটা থাকছে বলা মুশকিল। এটা খুবই ক্ষতিকর। আমরা দীর্ঘ সময়ে যুক্তির মধ্য দিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছেছি। এই যুক্তির মধ্যে একটা সত্যতা তো আছে। এখন এই সত্যতা বা যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে নানাভাবে।

প্রশ্ন:

আইনকানুন আনার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় স্তরে নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই বাড়ছে। যেমন ধর্ম অনুযায়ী ভারতে ঐতিহ্যগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন বদলে দিয়ে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনার কথা বলা হচ্ছে।

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ, আমি এটাই ভাবছিলাম। সব লোককেই যে ঠিক একই ধরনের নিয়ম মেনে চলতে হবে, এর প্রয়োজনটা ঠিক কোথায়? সেটা ভাবারও তো একটা প্রয়োজন আছে। আর সেটা হলে কাদের সুবিধা হয় বা কাদের সুবিধার জন্য ব্যবস্থা চালু হতে পারে, এটা আমাদের খুবই ভাবা দরকার। একটি অংশের ধর্মের ক্ষমতা এবং অন্যদের ওপরে চাপ দেওয়ার ক্ষমতা যদি অনেক বেশি হয়, তাঁরা যা মনে করেন তা খুব সহজেই চালু হতে পারে। যদি আমরা বলি যে সব জায়গাতেই একধরনের নিয়ম চলুক, তাহলে বিষয়টা শেষ পর্যন্ত কেমন হবে, এটা ভাববার বিষয়।

প্রশ্ন:

নিয়মিত আদমশুমারির তথ্য প্রকাশ করা আমাদের অত্যন্ত গর্বের বিষয় ছিল। এখন সেগুলো নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগে আদমশুমারির তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। ২০২১-২২ সালে যা প্রকাশ করার কথা ছিল, তা পিছিয়ে গেল। শেষ শুমারি হয়েছে ২০১১ সালে। এই তথ্যকে তারা কেন ভয় পাচ্ছে? কেন বারবার পিছিয়ে দিতে চাইছে?

অমর্ত্য সেন: সত্যের অভাবে ক্ষমতা অনেক দিক থেকে লাভবান হয়। এর অনেক প্রমাণ আছে। নানা দিক দিয়ে তারা এর থেকে সাহায্য পায়। আমার ধারণা, সরকার এ মুহূর্তে কিছু জিনিস চায় না। যেমন (তারা চায় না যে) বেকারত্ব ও দারিদ্র্য নিয়ে বিশেষ তথ্য প্রকাশ পাক। সরকার চায় না যে এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা হোক। সত্যকে ধামাচাপা দিতে পারলে...সরকারি প্রকল্পে সুবিধা পেতে আধার (পরিচয়পত্র) ব্যাংকের যুক্ত করা হচ্ছে। আশা করা হয়েছিল, এতে কিছুটা লোকের সুবিধা হবে। বাস্তবে তা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।

প্রশ্ন:

আমরা দেখছি, কেন্দ্র সরকার ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতিকে সামনে নিয়ে এসে বিরোধীদের ভয় দেখাচ্ছে, জেলে পুরছে, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে মামলা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো রাজনৈতিক নেতাই হয়তো দুর্নীতিহীন নন। কিন্তু শুধু বিরোধীদের বিরুদ্ধে এটা যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কি আপনার মনে হয় যে দুর্নীতি নিয়ে একটা নতুন বয়ান আমাদের দরকার?

অমর্ত্য সেন: দুর্নীতি যে একটা ইস্যু নয়, এটা আমি বলব না। দুর্নীতি নানাভাবে আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু আমাদের দুর্নীতি বিষয়টাকেই অন্যভাবে দেখা উচিত। এটা এ রকম নয় যে ভারতের কেন্দ্র সরকার দুর্নীতি নিয়ে এতটাই চিন্তিত যে দুর্নীতি হলেই খপ করে গিয়ে ধরছেন। তবে হ্যাঁ, লোককে জেলে পাঠাতে হলে দুর্নীতি একটা বড় রকমের অজুহাত। তাই দুর্নীতি আছে বলেই আমাদের দেশে এ রকমটা করা হচ্ছে, এটা ঠিক ভেবে নেওয়া যাচ্ছে না। দুর্নীতি তো সব দেশেই আছে। ইতালিতেও আছে, গ্রিসেও আছে। তার মানে আবার এই নয় যে আমাদের দুর্নীতি নেই।