নির্বাচনী প্রচার শেষ, কার দখলে যাচ্ছে কর্ণাটক
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্ব আজ সোমবার শেষ হলো। শেষ দিনে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছে বিজেপি। চিঠি দিয়ে বিজেপির পক্ষে বলা হযেছে, প্রচারে সোনিয়া অসাংবিধানিক মন্তব্য করেছেন। কর্ণাটকের ‘সার্বভৌমত্ব’ রক্ষার কথা বলে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
গত শনিবার হুবলি–ধারওয়ার কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী জগদীশ শেট্টারের সমর্থনে সোনিয়া এক জনসভায় ভাষণ দেন। বিজেপির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শেট্টার এবার টিকিট না পেয়ে দলত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। এই প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের নেতার সমর্থনে প্রচারে সোনিয়া বলেন, কর্ণাটকের মান, মর্যাদা, সংহতি ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কিছু কংগ্রেস সহ্য করবে না।
গতকাল রোববার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দটিকে হাতিয়ার করে সোনিয়ার সমালোচনা করেন। বলেন, স্বাধীন দেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলা হয়। সোনিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী কর্ণাটক স্বাধীন। ভারতের অঙ্গ নয়। কংগ্রেসকে নিশানা করে এরপর তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার, ওরা কর্ণাটককে ভারত থেকে আলাদা করতে চাইছে।
আজ সোমবার বিজেপি নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানায়। সোনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আরজি জানিয়ে নালিশে অভিযোগ করা হয়, কংগ্রেস কর্ণাটকের সুস্থিতি নষ্টের চক্রান্ত করছে। বিশেষ সম্প্রদায়ের ভোট পেতে চাইছে। রাজ্যকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধেও কমিশনে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি অভিযোগই ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা নিয়ে। কিন্তু কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ জন্য তাদের সমালোচিত হতে হচ্ছে। বিজেপির সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত বলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় কমিশন কংগ্রেসকে নোটিশ পাঠিয়ে প্রমাণ দাখিল করতে বলেছে।
কর্ণাটক বিধানসভার মোট আসন ২২৪। ২০১৮ সালের ভোটের পর বিজেপিকে (১০৪ আসন) দূরে রাখতে কংগ্রেস (৮০) ও জেডিএস (৩৭) জোট বেঁধে সরকার গড়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন জেডিএসের কুমারস্বামী। কিন্তু ১৪ মাস পর দুই দলের বিধায়কদের পদত্যাগ ঘটিয়ে বিজেপি সরকার গড়ে। দুবার মুখ্যমন্ত্রী বদল করেও সরকার জনপ্রিয় হতে পারেনি। দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক হয়ে উঠেছে। ‘৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও নষ্ট হয়েছে বারবার। দলের প্রতি আস্থা ফেরাতে বিজেপি এবার পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত নেতাদের বঞ্চিত করে নতুন ৬২ জন প্রার্থী করেছে। ফলে প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত সমাজের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রীসহ একাধিক প্রভাবশালী নেতা দলত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ কংগ্রেসে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন।
বি এস ইয়েদুরাপ্পার মতো প্রবীণ নেতাকে বিজেপি এবার প্রার্থী করেনি। টিকিট দিয়েছে তাঁর ছেলেকে। প্রচারে ইয়েদুরাপ্পাকে সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বস্তুত, রাজ্য নেতাদের ওপর ভরসা না করে প্রচারের অভিমুখ করে তোলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। ভোটের আগে মোট ১২ বার প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণের এই রাজ্যে এসেছেন। কখনো প্রকল্প উদ্বোধনে, কখনো নির্বাচনী প্রচারে। গত ১০ দিন কর্ণাটকই তাঁর ঠিকানা। মোট ২১টি জনসভা ছাড়াও গত শনি ও রোববার তিনি বেঙ্গালুরুতে রোড শো করেছেন।
মোদি ছাড়াও প্রচারে অংশ নিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও দলের সভাপতি জে পি নাড্ডা। মেরুকরণের লক্ষ্যে প্রচারে আনা হয় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাকেও। দেড় বছর ধরে কর্ণাটকের জনজীবন হিজাব–হালাল–আজান–আমিষ বিতর্কে আবর্তিত।
এই রাজ্যে কংগ্রেসের প্রচার সেই অর্থে ‘হাইপার লোকাল’। দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ কংগ্রেসের প্রচারের প্রধান হাতিয়ার। কংগ্রেসের রাজ্য নেতারাও অন্য সব দলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ‘দলিত’। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া ‘অনগ্রসর’। প্রদেশ সভাপতি ডি কে শিবকুমার প্রভাশালী ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের। এদের সঙ্গে রয়েছে মুসলমানদের সমর্থন। সব জরিপেই কংগ্রেস এগিয়ে। ১৯৮০–এর দশকের পর এই রাজ্যে একই দল পরপর দুবার ক্ষমতায় আসেনি। সেদিক থেকে কংগ্রেস এবার যথেষ্ট আশাবাদী। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন বোন প্রিয়াঙ্কাও। সোনিয়াও শেষ বেলায় আসরে নেমেছেন। নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া হয়েছে জনমুখী প্রতিশ্রুতি।
বিজেপির কেউই সাড়ে তিন বছরের সরকারি সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরতে পারছেন না। প্রচারে একমাত্র অনুরোধ ‘মোদির হাত শক্ত করার’। বিজেপি জিতলে একমাত্র মোদিই হবেন সেই জয়ের কান্ডারি। হারলে দায় দলের রাজ্য নেতাদের।
জেডিএস এই রাজ্যে তৃতীয় শক্তি। দক্ষিণ কর্ণাটকে এই দলের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ভোটের ফল ত্রিশঙ্কু হলে গতবারের মতো এবারেও জেডিএস হয়ে উঠবে নির্ণায়ক দল।