হরিয়ানায় ধর্মীয় শোভাযাত্রায় কারা অস্ত্র দিল: প্রশ্ন বিজেপির মন্ত্রীর

হরিয়ানা রাজ্যের নুহ জেলায় সহিংসতার সময় পুড়িয়ে দেওয়া বাস সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ১ আগস্ট
ছবি: এএনআই

হরিয়ানা রাজ্যে সহিংসতায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আজ বুধবার বেড়ে ৬ হয়েছে। আহত হয়েছেন ১১৬ জন। নুহ জেলায় সংঘর্ষে আহত বজরঙ্গ দলের আহ্বায়ক প্রদীপ শর্মা আজ সকালে মারা গেছেন।

গত সোমবার হরিয়ানার নুহ জেলায় হিন্দুদের এক ধর্মীয় শোভাযাত্রা রোখা নিয়ে দুই পক্ষের গোলমালের রেশ আজ বুধবারও গুরুগ্রামের কোনো কোনো এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। অবশ্য গুরুগ্রাম পুলিশের দাবি, আজ নতুন করে কোনো উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেনি। ছোটখাটো দু-একটি ঘটনা ঘটলেও নতুন করে সংঘর্ষ বাধেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে সব পেট্রলপাম্পকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন কাউকে বোতল বা অন্য পাত্রে পেট্রল-ডিজেল বিক্রি না করে।

গুরুগ্রাম থেকে রাজধানী দিল্লির দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। স্বাভাবিকভাবেই দিল্লিতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে। হিন্দুধর্মীয় শোভাযাত্রা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে আজ সকালে পশ্চিম দিল্লির নাঙ্গলোই চকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্যানারে দুই শতাধিক তরুণ বিক্ষোভ মিছিল বের করতে চেয়েছিলেন। পুলিশ তাঁদের মিছিল করতে দেয়নি।

দিল্লি পুলিশের বিশেষ কমিশনার দীপেন্দ্র পাঠক জানিয়েছেন, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে (ভিএইচপি) মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোথাও এমন মিছিল যাতে না বের হয়, সে জন্য নির্দেশও জারি করা হয়েছে।’

হরিয়ানা পুলিশ কাউকে গুজব না ছড়াতে প্রচার চালাচ্ছে। রাজ্য পুলিশ জানিয়েছে, উপদ্রুত এলাকাগুলোয় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও রাজ্যের অন্যত্র স্বাভাবিক। গুরুগ্রামের কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থা অবশ্য কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।

গত সোমবার দুই পক্ষের সংঘর্ষের কারণ হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তিনটি ভিডিওকে দায়ী করা হচ্ছে। ওই সব ভিডিওর দুটি মনু মানেসর নামের এক যুবকের, তৃতীয়টি বিট্টু বজরঙ্গীর।

দুজনেই স্বঘোষিত গোরক্ষক। তাঁরা নাকি বলেছিলেন, ওই ধর্মীয় শোভাযাত্রায় তাঁরা যোগ দেবেন। তাঁদের মধ্যে মনু মানেসরকে রাজস্থান পুলিশ খুঁজছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজস্থানের ভরতপুরের দুই মুসলমান যুবককে হরিয়ানার ভিওয়ানি জেলায় তিনি হত্যা করেন। পুড়ে যাওয়া একটি গাড়ির মধ্যে ওই দুই যুবকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তাঁরা গোহত্যার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ।

পুলিশ অবশ্য বলেছে, মনু বা বিট্টু কেউ-ই সোমবারের শোভাযাত্রায় যোগ দেননি।

একই দাবি করেছেন মনুও। আজ এক ভিডিও বার্তায় তিনি তাঁর বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে কথাও বলেছেন। প্রশ্ন উঠছে, রাজস্থান পুলিশ খুনের অভিযোগে যাঁকে খুঁজছে, তিনি কী করে নির্বিঘ্নে হরিয়ানায় লুকিয়ে থাকেন?

হরিয়ানার নুহ মুসলমানপ্রধান জেলা। ধর্মীয় শোভাযাত্রা নিয়ে তিন দিন ধরে চলা প্রচার সত্ত্বেও পুলিশ কী করে সেই শোভাযাত্রার অনুমতি দেয়, সেই প্রশ্নও উঠছে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে কী করে অস্ত্র থাকে, সেই প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে।

হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার বলেছেন, এই সংঘর্ষের পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে।

উপমুখ্যমন্ত্রী বিজেপির শরিক জেজেপি দলের নেতা দুষ্মন্ত চৌটালা কিন্তু বলেছেন, শোভাযাত্রাকারীরা পুলিশকে অনেক তথ্য গোপন করেছিল। সে জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, পুলিশ ওই সংঘর্ষ এড়াতে পারত।

রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের দাবি, তাঁরা গোলমালের আশঙ্কার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন।

সরকারের শরিক হলেও বিজেপি ও জেজেপির পারস্পরিক টানাপোড়েন এই দুই পরস্পরবিরোধী মন্তব্য থেকে স্পষ্ট। গুরুগ্রাম থেকে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাও ইন্দ্রজিৎ সিংও শোভাযাত্রাকারীদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, প্ররোচনা মোটেই একতরফা ছিল না।

ধর্মীয় শোভাযাত্রায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের হাতে অস্ত্র কারা তুলে দিল? কোন পুণ্যার্থী সশস্ত্র অবস্থায় ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশ নেন?

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করলেও বিরোধীরা বিজেপিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, আরজেডি, বামপন্থীসহ ‘ইন্ডিয়া’জোটের সব শরিকই মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ও বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে চলেছে। ক্রমাগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর ফলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে। দাঙ্গা বাধছে।

বিরোধী নেতারা এই প্রসঙ্গে জয়পুর-মুম্বাই সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনে সাম্প্রতিক গুলি চালনার ঘটনারও উল্লেখ করছেন। সেই ট্রেনে রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্সের কনস্টেবল চেতন সিং বেছে বেছে তিন মুসলমান যাত্রীকে গুলি করে মারেন। গুলি চালানোর সময় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ভারতে থাকতে হলে, ভোট দিতে হলে, শুধু দুজনকে সমর্থন করতে হবে। মোদি ও যোগী।’

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও বলেন, বিজেপি, সংবাদমাধ্যম ও তাদের সঙ্গে মিশে থাকা শক্তি গোটা দেশে ঘৃণার কেরোসিন ছড়াচ্ছে। একমাত্র ভালোবাসা পারে ওই আগুন নেভাতে।

বিরোধীদের মতে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও তেলেঙ্গানার ভোটের আগে বিজেপি পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে। মনে করছে, ধর্মীয় মেরুকরণ তাদের ভোট বৈতরণি পার করাবে। সর্বভারতীয় কৃষক সভাও এই একই অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ, সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টিতে রাজ্য রাজ্যে গোরক্ষা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।