মণিপুরে দুই নারীর নগ্ন ভিডিওর ঘটনায় লোকসভায় আলোচনা করতে দিল না বিজেপি সরকার

মণিপুরে দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটিয়ে নেওয়া ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার মেইতি জনগোষ্ঠীর হুইরেম হিরোদাস মেইতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার তোলা
ছবি: এএনআই

ভারতের মণিপুর রাজ্যের জাতিগত দাঙ্গা ও সহিংসতার এক পুরোনো ভিডিও জাতীয় রাজনীতিকে নতুন করে উত্তাল করে তুলেছে। সর্বত্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, সুপ্রিম কোর্টও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারের উচিত এখনই ব্যবস্থা নেওয়া। তারা না করলে সুপ্রিম কোর্ট পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।

এই সর্বব্যাপী চূড়ান্ত ক্ষোভের মধ্যে এত দিন ধরে মণিপুর নিয়ে মৌন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার মুখ খুলেছেন। সংসদের অধিবেশন শুরুর আগে প্রথামাফিক ভাষণে তিনি বলেন, এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একজন অপরাধীও পার পাবে না।

বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ভারতীয় সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। সংসদের দুই কক্ষেই মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি আলোচনার দাবি জানিয়েছেন বিরোধীরা। কিন্তু সভার স্বাভাবিক কাজ বন্ধ রেখে আলোচনায় সম্মত হননি লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়। ফলে দুই কক্ষের অধিবেশনই সারা দিনের মতো মুলতবি হয়ে যায়। এর মধ্যেই বিরোধীরা তীব্র ভাষায় সরকারকে আক্রমণ করেন।

মণিপুরের সহিংসতার যে ভিডিও বুধবার রাতে ভাইরাল হয়, সেটি আড়াই মাস আগের। গত ৩ মে উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় এই রাজ্যের হিন্দু মেইতি ও খ্রিষ্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। পরদিন ৪ মে ওই ভিডিও ধারণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র একদল উন্মত্ত জনতা। রাস্তা দিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটিয়ে ওই দুই নারীকে একটি মাঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অভিযোগ, সেই মাঠে প্রকাশ্যে ওই দুই নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।

আড়াই মাসের পুরোনো ওই ভিডিও কে বা কারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল, কোন উদ্দেশ্যে, তা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু তা দ্রুত আলোচনায় উঠে আসে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে। বুধবার রাতেই কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে ওঠে। বৃহস্পতিবার সকালে টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে ভিডিওটি প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সরকারি কর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সামাজিক মাধ্যমের বোঝা উচিত, ভিডিওটি নতুন করে অশান্তি ডেকে আনবে। তাই তাদের প্রথমেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল।

সরকার ক্ষুব্ধ হলেও ঘটনা হলো, আড়াই মাসের পুরোনো ওই ভিডিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাধ্য করে মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে। গত আড়াই মাসে যিনি একটি বাক্যও বলেননি, এত মৃত্যু ও সহিংসতার বিরুদ্ধে যিনি রা কাড়েননি, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার আবেদন পর্যন্ত জানাননি অথবা রাজ্য সরকারকে কর্তব্য সচেতন হতে প্রকাশ্যে পরামর্শ দেননি, সেই প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বলেন, এ ঘটনা দেশের জন্য লজ্জার। এ ঘটনা দেশের মাথা নত করে দিয়েছে। মণিপুরের মেয়েদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। দোষীরা কঠোর শাস্তি পাবে। কেউ পার পাবে না।

শুধু প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা ভঙ্গই নয়, এই ভিডিও ভাইরাল হয় বলেই ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বৃহস্পতিবার দুজনকে মণিপুরে গ্রেপ্তার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং নিজেই সেই গ্রেপ্তারের খবর জানান। এখানেই প্রশ্ন—এত দিন কেন ধরা হয়নি?
প্রশ্নটা উঠেছে কারণ, যে দুই নারী সম্ভ্রমহানির শিকার হয়েছেন, তাঁদেরই একজন বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ৪ মে ওই ঘটনার ১৪ দিন পর ১৮ মে থানায় এফআইআর করা হয়েছিল। তাহলে কেন এত দিন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাউকে ধরা হয়নি? ওই নারী এ কথাও বলেছেন, পুলিশ তাঁদের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু তারাই আবার তাঁদের উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দিয়েছিল।

১০ সপ্তাহ ধরে মণিপুর অশান্ত। এ সময়ে ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত সহস্রাধিক। অগুনতি ঘরবাড়ি, গির্জা ও মন্দির ধুলিসাৎ হয়েছে। ৬০ হাজার শরাণার্থীশিবিরে বন্দী; অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। সংসদে এই ঔদাসীন্য নিয়েই সরকারকে আক্রমণের উদ্দেশে বিরোধীরা মুলতবি প্রস্তাব পেশ করেন। যদিও কোনো কক্ষেই তা গৃহীত হয়নি। ফলে দুই কক্ষের অধিবেশনও সারা দিনের মতো ভন্ডুল হয়ে যায়। সাধারণত আইনশৃঙ্খলাজনিত বিতর্কে জবাব দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে।

সরকারবিরোধীরা সেই সুযোগ পাবেন কি না, সন্দেহ। তবে বৃহস্পতিবারই তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে তুলাধোনা করেছেন। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, ‘১ হাজার ৮০০ ঘণ্টা ক্ষমাহীন নীরবতার পর প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে ৩০ সেকেন্ড কথা বলেছেন। সেই ফাঁকে নিজেদের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা আড়াল করতে তিনি কংগ্রেসশাসিত রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের নারী নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ ভুলে গেলেন উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কথা।’

সিপিএম নেত্রী সুহাসিনী আলি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে টুইট করে লেখেন, ‘দেশবাসী লজ্জিত। কিন্তু আপনি কি আদৌ লজ্জিত? দিব্যি তো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছবি তোলাচ্ছেন। নিজেকে নিয়ে মগ্ন রয়েছেন। আপনি কি জানেন, ওই ঘটনা ৪ মে ঘটেছিল?’