আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফুটবলার এখন ফুড ডেলিভারি গার্ল

মানুষের অর্ডার করা খাবার পিঠের বড় ব্যাগে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন পৌলমী।
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

পৌলমী অধিকারীর সকালটা শুরু হয় অন্যদের চেয়ে একটু আগেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। এরপর মানুষের অর্ডার করা খাবার পিঠের বড় ব্যাগে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে দেন গ্রাহকের ঘরে। এ করেই তাঁর দিন চলে। কাজ করছেন ভারতের খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জোমাটোতে।

পৌলমী আগে সকাল সকাল ফুটবল নিয়ে ছুটতেন মাঠে। ফুটবল তাঁর নেশা। অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। আর এখন ভাগ্যের ফেরে সকালে বলের নেশা ছেড়ে সাইকেল নিয়ে ছুটতে হচ্ছে মানুষের বাড়ি বাড়ি। অভাব তাঁকে মাঠ থেকে তুলে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ভাঙাচোরা পথে।

২৪ বছর বয়সী পৌলমী বলেন, তাঁর চাকরি এখন জোমাটোর অ্যাপে অর্ডার হওয়ার খাবার গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর নেশা হলো ফুটবল।

পৌলমী একসময় ভারতের অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলের হয়ে ফুটবল খেলতেন। অনেক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। কিন্তু এই খেলা পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন কমাতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে এ কাজ খুঁজে নিতে হয়েছে।

২০১৩ সালে পৌলমী খেলতে শ্রীলঙ্কায় যান। সেখানে তিনি সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচে অংশ নেন। ২০১৬ সালে হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে (আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট) খেলতে গ্লাসগো যান।

কলকাতার হুগলী নদীর দক্ষিণে শিবরামপুরে নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম পৌলমীর। স্থানীয় মানুষ তাঁকে বুল্টি নামে ডাকেন। দুই মাস বয়সেই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর মাসির (মায়ের বোন) সংসারে থেকে বড় হয়েছেন। তাঁর বাবা একজন খণ্ডকালীন ট্যাক্সিচালক।

সাত বছর বয়সে পাড়ার মাঠে স্থানীয় ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখে মাঠে যাওয়ার আগ্রহ জাগে পৌলমীর। ছেলেদের মতো পোশাক পরে বলে সহজেই মাঠে খেলায় নেমে যেতে পারেন তিনি। খেলার সাথিরাও বিশ্বাস করেছিল, পৌলমী ছেলে।

পৌলমী বলেন, ‘কিন্তু যখন তারা জানতে পারল আমি মেয়ে, তখন তাদের অভিভাবকেরা মাঠ কর্তৃপক্ষ ও আমার খালার কাছে অভিযোগ জানানো শুরু করেন। তাঁরা বলেছিলেন, শর্টস পরা একটি মেয়ে কীভাবে ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলে?’

এ ঘটনায় পৌলমী খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি সত্যি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। মাঠে খেলব, এটা খুব করে চাইতাম। এ কারণে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন কাঁদতাম।’

অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন পৌলমী।
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

পৌলমীর মাসি বলেন, তিনি পৌলমীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে নানা কাজ করেছেন। তাঁর অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছেন। এতে পৌলমী ভালো করেছেন। দ্রুত তিনি স্থানীয় ফুটবল কোচ অনিতা সরকারের নজরে এসেছেন। পরে অনিতা সরকারের তত্ত্বাবধানে পৌলমী কলকাতা ফুটবল লিগে মেয়েদের দলে খেলেছেন। আর মাত্র ১২ বছর বয়সেই ভারতের অনূর্ধ্ব-১৬ দলের খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন।

‘ভারতের জার্সি পরা ও অল্প বয়সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা আমার ক্যারিয়ারের জন্য সেরা মুহূর্ত ছিল। প্রথমবারের মতো যখন দেশের জার্সি পরেছিলাম তখন অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম,’ স্মৃতি খুঁজে এভাবে বলছিলেন পৌলমী।

২০১৩ সালে পৌলমী খেলতে শ্রীলঙ্কায় যান। সেখানে তিনি সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপের যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচে অংশ নেন। ২০১৬ সালে হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে (আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট) খেলতে গ্লাসগো যান। সেখানে তাঁকে প্রতি ম্যাচে খেলার জন্য প্রায় ১০০ ডলার করে দেওয়া হতো। কিন্তু সেখানে কিছু অসুবিধাও ছিল।

পৌলমী বলেন, ‘আমাদের পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে কখনোই ফুটবল খেলার সরঞ্জাম সঠিকভাবে নিতে পারিনি। এমনকি দিনে তিনবেলাও ঠিকমতো জোটে না।’
২০১৮ সালে একটা বড় ধাক্কা পান পৌলমী। পায়ে বড় ধরনের চোট পাওয়ার কারণে কয়েকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। তাঁকে অনেক দিন বিশ্রামে থাকতে হয়। এরপর মাঠে ফেরার মতো পুরো সুস্থ হয়ে উঠলেও পরিবারের চরম অনটন মাঠে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা যদি ভারতের কথা বলি এবং পুরুষ ও নারী ফুটবলের তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে, অনেক মানুষ নারীদের ফুটবল দেখেন না এবং এটা নিয়ে ভাবেন না। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আমি পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য মানুষকে চাকরি থেকে ছুটি নিতে দেখেছি, কিন্তু তাঁরা নারীদের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। তাই খেলাধুলায় সামগ্রিকভাবে নারীরা অবহেলিত।
পৌলমী অধিকারী

পৌলমীর বড় বোনের বিয়ে হওয়ায় শ্বশুরবাড়ি চলে গেছেন। এ কারণে পরিবারে একটু সাহায্য করতে তাঁকে কাজ খুঁজতে হয়। স্বপ্নের খেলা ফেলে, মাঠ ফেলে তাঁকে হন্যে হয়ে কাজের সন্ধান করতে হয়। ২০২০ সালে যখন করোনা মহামারির শুরুর দিকে তিনি খাবার সরবরাহকারী এজেন্ট হিসেবে চাকরি পেয়ে যান।

এ কাজে কোনো কোনো দিন তাঁকে রাত একটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এ কারণে আর মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা হয় না। পুরোদস্তুর চাকরি করেন তিনি। এ কাজে দিনে তাঁর এখন আয় হয় ৩০০ রুপি। আর দুই পালায় প্রায় ১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাঁকে।

পৌলমী বলেন, ‘আমি যদি একটা ভালো বেতনের চাকরি পাই, যেখানে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে পারব, তাহলে আমি সহজেই ফুটবলের জন্য ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় বের করতে পারব।’

ভারতে খেলাধুলা করে নারীদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ নেই। আপনি যদি পৌলমীর মতো দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন, তাহলে তা আরও কঠিন।
শান্তি মল্লিক, ভারতের জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক স্ট্রাইকার

পৌলমী আরও বলেন, নারীদের খেলাধুলায় বিনিয়োগ করার জন্য দেশে, এমনকি সম্ভবত বিশ্বেরও  ইচ্ছা নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ভারতের কথা বলি এবং পুরুষ ও নারী ফুটবলের তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে, অনেক মানুষ নারীদের ফুটবল দেখেন না এবং এটা নিয়ে ভাবেন না। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আমি পুরুষদের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য মানুষকে চাকরি থেকে ছুটি নিতে দেখেছি, কিন্তু তাঁরা নারীদের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। তাই খেলাধুলায় সামগ্রিকভাবে নারীরা অবহেলিত।’ তিনি এখনো প্রত্যাশা করেন, যথাযথ সমর্থন পেলে তিনি আবারও পেশাদারভাবে খেলতে পারবেন।

ভারতের জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক স্ট্রাইকার শান্তি মল্লিক দেশটির প্রথম নারী ফুটবলার, যিনি মর্যাদাপূর্ণ অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভারতে খেলাধুলা করে নারীদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ নেই। আপনি যদি পৌলমীর মতো দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন, তাহলে তা আরও কঠিন। পরিস্থিতি অন্য রকম হলে পৌলমী পেশাদার খেলোয়াড় হতে পারতেন। আমি আশা করি, তাঁর এই গল্প আমাদের নারী ফুটবলে বিকাশ ও বিনিয়োগকে অনুপ্রাণিত করবে। তাহলে আমাদের আর কোনো প্রতিভা হারিয়ে যাবে না।’