নির্বাচনের আগে দুর্নীতি–কাণ্ডে চাপ বাড়ছে তৃণমূলের ওপর

মহুয়া মৈত্র, চন্দ্রনাথ সিনহা, স্বরূপ বিশ্বাসছবি: ভাস্কর মুখার্জি

চন্দ্রনাথ সিনহা, স্বরূপ বিশ্বাস এরপর মহুয়া মৈত্র। একের পর এক ডাকসাইটে তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীদের বাড়িতে চলছে ভারতের একাধিক তদন্ত সংস্থার তল্লাশি। নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই চাপ বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল নেতৃত্বের ওপর। শাসক দলের অভিযোগ, লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার তারা।

আর বিজেপিসহ বিরোধীদের কথা, দিন যত যাচ্ছে তৃণমূলের অপরাধের উন্মোচন হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এবার নির্বাচনের বৈতরণী পার তৃণমূলের জন্য সুবিধার হবে না, সেটা নিশ্চিতই বলা যায়। এ রাজ্যে কয়েক দফায় নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট হয়েছে। আর নির্বাচনের আগে বড় নেতাদের বাড়িতে তল্লাশি চাপের একটি কৌশল।  

ভারতের লোকসভার নির্বাচন শুরু হবে ১৯ এপ্রিল থেকে ৫৪৩ আসনে। চলবে ৭ দফায়। তবে থাকছে এক দফা থেকে সাত দফার নির্বাচন তফসিল। সাত দফার নির্বাচন হবে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশে।

দুর্নীতি–কাণ্ডে জড়িয়ে পড়া তৃণমূলের নেতাদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা–সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট–ইডি এবং আয়কর দপ্তর। অনেক আগে থেকেই দুর্নীতি–কাণ্ডে জড়িয়ে তৃণমূলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডল, যুব নেতা কুন্তল ঘোষসহ আরও অনেকে এখন সিবিআই ও ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।

এর মধ্যে গতকাল শনিবার তৃণমূলের প্রভাবশালী নেত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য ও এবারে কৃষ্ণনগর আসনের তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্রর কলকাতাসহ কৃষ্ণনগরের তাঁর দপ্তর, দলীয় কার্যালয়সহ করিমপুরের পাঁচ জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে সিবিআই। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই তল্লাশি চলে।

গত শুক্রবার সকাল থেকে ভোর অবধি বীরভূমের বোলপুরে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা চন্দ্রনাথ সিনহার বাসভবনে তল্লাশি চালায় ইডি। সেই বাসভবন থেকে ইডি উদ্ধার করেছে নগদ ৪১ লাখ রুপি। আটক করেছে বেশ কিছু নথি এবং একটি মুঠোফোন।

এ ছাড়া রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের নিউ আলিপুরের সাহাপুর কলোনির বাসভবনে তিন দিন একটানা ৭১ ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে শনিবার তাঁকে ইডি দপ্তরে দেখা করার সমন ধরিয়ে আগামী সপ্তাহে হাজির হওয়ার নোটিশ দেন।

মহুয়া মৈত্র ২০১৯ থেকে কৃষ্ণনগর আসনের সংসদ সদস্য থাকলেও তিনি অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগে দণ্ডেত হয়ে ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার সংসদ সদস্যের পদ থেকে বহিষ্কৃত হন গত ৮ ডিসেম্বর।

কিন্তু এবার পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এই মহুয়া মৈত্রকে আবার প্রার্থী করে তৃণমূল কৃষ্ণনগর আসনে। এখানে বাম দলের প্রার্থী হয়েছেন এস এম সাদি। বিজেপি ও কংগ্রেস দলের প্রার্থিতা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফায় ১৩ মে কৃষ্ণনগর আসনে নির্বাচন হবে।

এসব ঘটনার পর মহুয়া মৈত্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সিবিআই আমার ঘর আর আমার নির্বাচনী কার্যালয় তল্লাশি করতে এসেছিল। কিছুই পায়নি। আর আমি এবং প্রার্থী সায়নী ঘোষ নেমেছি আমাদের আসনের বিজেপির প্রার্থী খোঁজ করতে।’

তবে বাসভবন থেকে নগদ ৪১ লাখ রুপি উদ্ধার হলেও সে ব্যাপারে মুখ খোলেননি মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহা। তবে মন্ত্রীর পরিবারের ঘনিষ্ঠরা বলেছেন, এই টাকা গ্রামের বাড়ির জমির চাষের জন্য রাখা হয়েছিল।

মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের বাসভবনে তল্লাশির পর স্বরূপ বিশ্বাস বলেছেন, ‘আমরা তৃণমূল করি। তাই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সিবিআইয়ের ইডি লাগিয়ে আমাদের হেনস্তা করা হয়েছে। কিছুই পায়নি বাড়ি থেকে।’

তবে এসব তল্লাশিতে খুশি বিরোধী দলগুলো।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘মন্ত্রীর বাসভবন চন্দ্রালয়ে চন্দ্রগ্রহণ শুরু হয়েছে।’

বোলপুর লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী প্রিয়া সাহা বলেছেন, ‘তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের বসভবন থেকে টাকা উদ্ধারের ঘটনা নতুন নয়। এবার জনগণ হিসাব বুঝে নেবে।’

চুপ করে নেই বামপন্থী দল সিপিএম।

বোলপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষ বলেছেন, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা  দুর্নীতিপরায়ণ এটা নতুন কিছু নয়, কালোটাকা ব্যাংকে রাখতে পারবে না বলে বাড়িতে রেখেছিল। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও বলেছেন, দুর্নীতির আখড়া তৃণমূল। জনগণ তা বুঝে নিয়েছে। ভোটেও তার প্রতিফলন ঘটবে।

কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও মন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন। বলেছেন, এবার আর অত সহজে পার পাবে না তৃণমূল।

এবার লোকসভা নির্বাচেন এক দফায় ভোট গ্রহণ হবে গুজরাট, কেরালা, তামিলনাড়, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা, উত্তরাখন্ড, পুদুচেরি, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অন্ধ্র পদেশ, চণ্ডীগড়, দিল্লি, গোয়া, লাদাখ, লাক্ষাদ্বীপ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম, উত্তরাখন্ড, দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউ’তে।

দুই দফায় নির্বাচন হবে কর্ণাটক, রাজস্থান, ত্রিপুরা ও মণিপুরে। তিন দফায় হবে ছত্রিশগড় ও আসামে, চার দফায় হবে ওডিশা, মধ্য প্রদেশ ও ঝাড়খন্ডে। পাঁচ দফায় নির্বাচন হবে মহারাস্ট্র ও জন্মু কাশ্মীরে। আর সাত দফায় হবে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর প্রদেশে।

পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের ভোট শুরু হবে ১৯ এপ্রিল। শেষ হবে ১ জুন। ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় প্রথম দফার নির্বাচনে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার আসনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে ২০ মার্চ থেকে। চলবে ২৮ মার্চ পর্যন্ত। ২ এপ্রিল থাকছে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৯ এপ্রিল নির্বাচন।