বাঙালি মুসলমানদের অবমাননা: আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর মামলা

অসম সংখ্যালঘু সংগ্রাম পরিষদ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি–মার্ক্সবাদী (সিপিআইএম), তৃণমূল কংগ্রেস ও আসামের রাজ্যসভার নির্দলীয় সদস্য অজিতকুমার ভূঁইয়া প্রমুখ মামলা করেন।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন
ফাইল ছবি: এএনআই

বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য বক্তব্যের অভিযোগে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার বেশ কয়েকটি অভিযোগ মামলা করেছে আসামের প্রধান বিরোধী দলগুলো। যখন দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরুতে জাতীয় স্তরে বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে আগামী লোকসভা নির্বাচন লড়াইয়ের বিষয়ে বৈঠক করছে, ঠিক সে সময় আসামে প্রায় প্রতিটি প্রধান বিরোধী দল বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

বাঙালি মুসলমানদের কিছুটা অবজ্ঞাসূচকভাবে রাজ্যে ‘মিয়া’ বলে চিহ্নিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আলাদাভাবে অভিযোগ দায়ের করেছে বিরোধী দলগুলো। তবে এখনো কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেনি।

মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধির জন্য ‘মিয়া’ চাষি ও ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্যকে দায়ী করে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ‘মিয়া’ মুসলমানদের কর্মচ্যুত করে অসমিয়া তরুণদের কৃষিকাজ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা।

গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে জার্মানিতে ইহুদিদের ওপর অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি পার্টি যে অত্যাচার শুরু করেছিল, তার প্রাথমিক ধাপ ছিল তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে ইহুদিদের সরিয়ে দেওয়া।

‘হলোকাস্ট এনসাইক্লোপিডিয়া’ নামের একটি ইন্টারনেটভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লিখছে, ‘১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি অ্যাডলফ হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসার পর নাৎসি নেতৃত্ব ইহুদিদের অর্থনৈতিকভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। নাৎসি দলের স্থানীয় প্রধানেরা জাতীয় বর্জন অভিযানের নেতৃত্ব দেন। অবশ্য এই বর্জন শুধু এক দিন স্থায়ী হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, অনেক সাধারণ জার্মান নাগরিক বর্জন উপেক্ষা করে ইহুদি মালিকানাধীন দোকানে কেনাকাটা করছেন। তবে এটা বলা যায়, ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নাৎসি পার্টির দেশব্যাপী প্রচারণার এটাই ছিল সূচনা।’

ভারতের উত্তর প্রদেশে গরুর ব্যবসা ও ওই রাজ্যের কানপুর জেলায় পারিবারিক চামড়ার ব্যবসা থেকে অনেকটাই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মুসলমান সমাজকে। ওই রাজ্যের মুসলমান সমাজ গত বছর এ কথা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন। এঁদের অনেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে ব্যবসা শুরু করেছেন। তবে পূর্ব ভারতে মুসলমান সমাজের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে এখনো বড় ধরনের আক্রমণ হয়নি।

কিন্তু এই প্রথম পূর্ব ভারতের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘অর্থনৈতিক বর্জন’ ঘোষণার পর সংখ্যালঘু সমাজের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করছেন ওই রাজ্যের বিরোধীরা। সেই কারণেই তাঁরা গতকাল মামলা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বিরুদ্ধে।

প্রথমে বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে মধ্য আসামের নগাঁও সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করে সংখ্যালঘু সংগঠন অসম সংখ্যালঘু সংগ্রাম পরিষদ। সংগঠনটি মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে ‘মিয়া’ এবং অসমিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই প্রথম পূর্ব ভারতের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘অর্থনৈতিক বর্জন’ ঘোষণার পর সংখ্যালঘু সমাজের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করছেন ওই রাজ্যের বিরোধীরা। সেই কারণেই তাঁরা গতকাল মামলা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বিরুদ্ধে।

আসামের রাজ্যসভার নির্দলীয় সদস্য অজিতকুমার ভূঁইয়াও দিসপুর থানায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

ভূঁইয়া অভিযোগে বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে সমাজে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মন্তব্য ও উত্তেজনা রোধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট আইন উদ্ধৃত করে মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি–মার্ক্সবাদী (সিপিআইএম) দলের আসাম রাজ্য কমিটিও রাজধানী গুয়াহাটি লাতাসিল থানায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।

দলের রাজ্য সম্পাদক সুপ্রকাশ তালুকদার ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইসফাকুর রহমান এ অভিযোগ এনেছেন। দুই বামপন্থী নেতা অভিযোগ করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণাপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন।

এ ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের আসাম শাখা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছে। এ ধরনের ঘৃণাপূর্ণ ভাষণ রোধে সুপ্রিম কোর্টের অতীতের নির্দেশ অমান্য করার কারণে বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছে তৃণমূল।

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি রিপুন বোরার বলেন, মিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, আসামে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যর্থতা এবং তার জন্য মুসলমান সমাজকে দোষারোপ করা এবং অসমিয়া যুবকদের কর্মচ্যুত করার প্রচেষ্টা প্রমাণ করে বিজেপি ও তার নেতারা পুরোপুরি বিভাজনের রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল।

তাৎপর্যপূর্ণভাবে সিপিআইএম আসামে প্রধানত বাঙালি মুসলমান সমাজের দল অল-ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রধান ও এমপি বদরুদ্দিন আজমলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগে বলা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায় নিয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে একই ধরনের বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে যাচ্ছেন আজমল।

আইনের প্রাসঙ্গিক ধারার অধীনে বিশ্বশর্মা ও আজমল উভয়ই ‘অপরাধী’ বলে দাবি করেছে সিপিআইএম। দুজনের বিরুদ্ধেই যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে অভিযোগে।

১২ জুলাই পশ্চিম আসামের ধুবরিতে অভিন্ন সিভিল কোড (ইউসিসি) সম্পর্কে আজমলের বিবৃতিকে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখছেন, যা সমাজকে ক্রমাগত আরও বিভাজিত করছে। এ কারণেই তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে সিপিআইএম।

আসামের মুখ্যমন্ত্রীর বাঙালি মুসলমানবিরোধী মন্তব্যের বিরোধিতা করে গত রোববারই প্রথম বক্তৃতা করেন জম্মু কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতি।

মেহবুবা বলেন, বিচার বিভাগ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য যদি ব্যবস্থা নিতে পারে, তখন বিশ্বশর্মার মন্তব্যের জন্যও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে নোটিশ পাঠানো উচিত বিচার বিভাগের।