ভারতে বিরোধী দলবিহীন ফাঁকা লোকসভায় বিতর্কিত বিল পাস

বিরোধী দলবিহীন ভারতের লোকসভায় নতুন বিলে সমর্থন দিচ্ছেন বিজেপির সদস্যরা। ২০ ডিসেম্বরছবি: এএনআই

বিরোধীহীন সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গতকাল বুধবার পাস হয়ে গেল বহু বিতর্কিত দুটি বিল। আজ বৃহস্পতিবার যা প্রায় বিরোধীশূন্য রাজ্যসভাতেও পাস হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা হলেই ‘দণ্ড সংহিতা’ বিলের মতো নতুন ‘টেলিকম’ বিলও আইনের মর্যাদা পেয়ে যাবে এবং সরকার হাতে পাবে ইচ্ছেমতো দমন-পীড়নের আরও ক্ষমতা।

ভারতীয় দণ্ডবিধি তৈরি হয়েছিল ১৮৬০ সালে। তার ১৩ বছর পর ১৮৭৩ সালে ফৌজদারি দণ্ডবিধি। এর এক বছর আগে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রণয়ন করেছিল সাক্ষ্য আইন। ব্রিটিশদের তৈরি ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে সন্ত্রাসবাদের উল্লেখ ছিল না। কাজেই তার সংজ্ঞাও ছিল না। একইরকম ছিল না গণপিটুনির উল্লেখ।

‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার’ তৈরি ওই তিন আইনের ভারতীয়করণের কাজে হাত দিয়ে বিজেপি সরকার যে তিন নতুন আইন নিয়ে এল, তাতে সন্ত্রাসবাদ ও গণপিটুনির অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, বিরোধীদের আপত্তি সেখানেই। তারা মনে করছে, নতুন এই আইনের মধ্য দিয়ে বিজেপি ভারতকে পুরোপুরিভাবে ‘পুলিশি রাষ্ট্রে’ পরিণত করবে।

ব্রিটিশ জমানার দণ্ডবিধি বদলে গতকাল লোকসভায় কণ্ঠভোটে পাস করানো হয় ভারতীয় ‘ন্যায় সংহিতা’, ‘নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ ও ‘সাক্ষ্য অধিনিয়ম’ বিল। এরই সঙ্গে পাস হয় নতুন টেলিকম বিলও। এ-সংক্রান্ত পুরোনো টেলিগ্রাফ ও ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ আইনও তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এই বিল নিয়েও বিরোধীরা শঙ্কিত। তাদের অভিযোগ, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ভারত সরকার যেকোনো টেলিযোগাযোগ পরিষেবার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে পারবে।

পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর ফোন ও তাতে পাঠানো খুদে বার্তাকেও টেলিযোগাযোগের আওতায় আনা হয়েছে। এর দরুন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে ‘হোয়াটসঅ্যাপ’, ‘সিগন্যাল’, ‘ভাইবার’ বা এ ধরনের ইন্টারনেটনির্ভর যোগাযোগের ফোনকল ও মেসেজের ওপরও সরকার নজরদারি চালাতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।

নতুন দণ্ডবিধিতে সন্ত্রাসবাদ ঢোকানোর প্রয়োজনীয়তা কেন—বিলের আলোচনায় গতকাল লোকসভায় সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এআইএমআইএমের সদস্য আসাউদ্দিন ওয়েইসি। তাঁর যুক্তি, দেশে জারি রয়েছে ‘ইউএপিএ’র মতো কঠোর আইন, যা বেআইনি কার্যকলাপ রোধের জন্যই তৈরি। সন্ত্রাসবাদ অবশ্যই বেআইনি, তাই নতুন আইনে নতুন করে সন্ত্রাসবাদের অন্তর্ভুক্তি অর্থহীন।

জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, অনেক রাজ্য ইউএপিএ প্রয়োগ করতে চায় না। তা ছাড়া সন্ত্রাসবাদ আজকের পৃথিবীতে নতুন সমস্যা।

ব্রিটিশদের তৈরি ‘রাজদ্রোহ’ আইন সরকার নতুন আইনে বাদ দিয়েছে। ওই আইন রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে খোদ সুপ্রিম কোর্ট বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে তার বদলে এসেছে নতুন ‘দেশদ্রোহ’ আইন।

নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বিলের ১৫০ ধারা অনুযায়ী, লিখিত বা মৌখিক বিবৃতি দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, দেশবিরোধিতা, উত্তেজনা সৃষ্টি কিংবা ওই ধরনের মানসিকতায় উৎসাহ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও একতাকে হুমকির মধ্যে ফেললে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাবাস হতে পারে। সেই সঙ্গে আর্থিক জরিমানা। দেশদ্রোহের কাজে আর্থিক সহায়তা দিলেও শাস্তি পেতে হবে।

বিরোধীদের দাবি, নতুন এই দেশদ্রোহ আইনও ভারতকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করবে। যেকোনো সরকারবিরোধিতা চিহ্নিত করা হবে রাষ্ট্রবিরোধিতায়। ইউএপিএ বা এনএসএর মতো এই আইনেরও অপব্যবহার করা হবে।

আরও পড়ুন

গণপিটুনিকে এই প্রথম আইনের আওতায় আনা হলো। গণপিটুনির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নারীর প্রতি অত্যাচারের সাজা নতুন আইনে আরও কঠোর করা হয়েছে। উৎপীড়নের নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞায় শারীরিকের সঙ্গে মানসিক অত্যাচারকেও ঢোকানো হয়েছে।

বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই লোকসভা ও রাজ্যসভাকে বিরোধীশূন্য করে তুলেছে, যাতে এসব বিতর্কিত বিল নিয়ে আলোচনার সময় বিরোধীরা সরব হতে না পারে। বিলগুলো যাতে প্রায় বিনা আলোচনায়, বিনা প্রতিরোধে অনায়াসে পাস হয়ে যায়।

১৩ ডিসেম্বর সংসদে ‘হামলা’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে বিক্ষোভ করায় দফায় দফায় ১৪৩ সংসদ সদস্যকে লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে পাইকারিহারে এতজন সদস্যকে বহিষ্কারের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।

আরও পড়ুন