চশমা পরে ধ্যান কেন: মোদিকে কংগ্রেসের কটাক্ষ

কন্যাকুমারীতে ধ্যানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ধ্যানের সময় তাঁর চোখে চশমা কেন, সেটা নিয়ে কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস। আজ ১ জুনছবি: এএনআই

ধ্যান ও মৌন পালনের দ্বিতীয় দিন আজ শনিবারও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাকডাকা ভোরে উঠে সূর্য প্রণাম করলেন। আজ ভোরে গেরুয়া বসনে মোড়া প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কমন্ডুলের জল সমুদ্রে ফেলে নবোদিত অরুণের স্তব করলেন। জপলেন হাতে ধরে রাখা রুদ্রাক্ষের মালা। তারপর বিবেকানন্দের মূর্তিতে প্রণাম করে বসলেন দ্বিতীয় দিনের ধ্যানে।

কন্যাকুমারী থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুই-ই দেখা যায়।

আজ শনিবার সপ্তম ও শেষ পর্বের ভোট শেষ হলে ধ্যান শেষ করে ও মৌন পালন ভেঙে প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাবেন দিল্লি, গোটা দেশ যখন ‘এক্সিট পোল’ বা বুথফেরত জরিপের ফল নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত থাকবে।

সপ্তম পর্বের ভোট চলাকালে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রার্থনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধী মহল সরব হয়েছিল।

তাদের পক্ষ থেকে দরবার করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশনে। আরজি ছিল, প্রধানমন্ত্রী ধ্যানে বসতেই পারেন, কিন্তু তা যেন গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত না হয়। সেটা হবে আদর্শ নির্বাচনী বিধিভঙ্গের শামিল।

কমিশন বিরোধীদের সেই আরজি খারিজ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রীও নির্দ্বিধায় দেশের শেষ প্রান্তে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ রকে ধ্যানমগ্ন হলেন। যদিও তা নিয়ে কটাক্ষে ভরিয়ে দিল বিরোধী দলগুলো।

ধ্যানমগ্ন প্রধানমন্ত্রীর ছবি, বিবেকানন্দ রকের বিভিন্ন অংশে তাঁর একাকী পদচারণ গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। সেই সঙ্গে আসতে থাকে সমালোচনার বন্যা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে যায় নানা মন্তব্যে। বিরোধীদের সমালোচনা উপেক্ষা করে সরব হয় বিজেপিও। প্রধানমন্ত্রীর মৌন পালন সৃষ্টি করে বিতর্ক। বিজেপি এটাই চেয়েছিল। শেষ পর্বের ভোটের প্রচার শেষ হলেও দারুণভাবে প্রচারের শীর্ষে চলে আসেন মোদি।

কংগ্রেস বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে গতকালই বলেছে, এটা হলো ‘সেভেন স্টার ধ্যান।’ জনতার উদ্দেশে কংগ্রেসের প্রশ্ন, কেউ কি কোনো দিন শুনেছেন, কারও ধ্যান গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে? কংগ্রেস মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে আবার জানতে চান, মুদিত নেত্রে ধ্যান করার সময় কেউ চশমা পরেন?

এসব কটাক্ষের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস এটাই বোঝাতে চেয়েছে, ধ্যানের পুরো ব্যাপারটাই নাটক। প্রচারের অঙ্গ। নির্ভেজাল রাজনৈতিক ভণিতা। কংগ্রেসের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্মী অঙ্কিত মায়াঙ্ক সরাসরি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রতি অতিরিক্ত মুগ্ধ। আত্মপ্রেমে মগ্ন। তিনি ‘নার্সিসিস্ট’। এই আত্মপ্রেম বিস্ময়কর। লজ্জাহীন এক চরিত্র।

মোদির ধ্যান শুরুর দিনেই ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের আশাব্যঞ্জক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ধ্যানরত অবস্থাতেই মোদি সেটি নিয়ে ‘এক্স’ হ্যান্ডলে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, দেশের অর্থনীতি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। কেরালার কংগ্রেস নেতৃত্ব সঙ্গে সঙ্গেই মোদিকে খোঁচা দিয়ে বলেছে, ধ্যানের সময় মনঃসংযোগ হারাবেন না। আত্মমগ্ন থাকুন। মুঠোফোন দূরে রাখুন।

মোদি অবশ্য মোটেই বান্ধবহীন হননি। দলের বিভিন্ন মহল থেকে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মোদির রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ইদানীং বিস্তর চর্চা হচ্ছে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল যেদিন জানিয়েছেন, তৃতীয়বার সরকার গড়লে মোদি দুই মাসের মধ্যে যোগী আদিত্যনাথকে সরিয়ে দেবেন, সেদিন থেকেই বিষয়টি আলোচিত।

সেই আদিত্যনাথ ধ্যানরত মোদির ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আধ্যাত্মিকতা আপনার আধার, ভক্তি আপনার শক্তি।’ অযোধ্যার রামমন্দিরের আচার্য সত্যেন্দ্র দাস বলেছেন, ‘কন্যাকুমারীতে ধ্যান করলে আলোকিত হওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী তাই করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমে তিনি সারা দেশের জন্য শক্তি ও সামর্থ্য আদায় করেছেন।’

কন্যাকুমারীর এই পর্যটনস্থল গত বুধবার থেকে সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী থাকবেন বলে ওই তল্লাটে কোনো জেলেকে সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য যেতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দল ও বাছাই করা গণমাধ্যম ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ। সমুদ্রের ধারের হোটেলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার পুলিশ সদস্য ২০ ঘণ্টা ওই তল্লাটে টহলে রয়েছেন।

অন্যান্য রাজ্য থেকে যেসব পর্যটক বিবেকানন্দ রক দেখবেন বলে এসেছেন, তাঁদের হয় প্রধানমন্ত্রীর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে, নয়তো না দেখেই ফিরে যেতে হবে।

ধ্যানমগ্ন মোদির যে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে, তার সর্বাঙ্গেও পেশাদারত্বের ছোঁয়া। মোট ৯টি ক্যামেরায় মোদির বিভিন্ন মুভমেন্ট ধরা হয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯২ সালে ভারতের এই শেষ ভূখণ্ডে তপস্যা করার পরের বছর শিকাগোতে মহাধর্মসভায় যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে সেই ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ দিকে তিনি যা বলেছিলেন, সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সেটাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

স্বামীজি তাঁর ভাষণের সেই অংশে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি স্বপ্ন দেখে যে শুধু তার ধর্মই বেঁচে থাকবে, অন্য ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তাহলে সেই ব্যক্তিকে আমি হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে করুণা করি। তাঁর উদ্দেশে বলতে চাই, প্রতিটি ধর্মের পতাকাতেই শিগগিরই লেখা হবে, একে অপরের পাশে দাঁড়াও। যুদ্ধ নয়। ধ্বংস নয়। একাত্ম হও। শান্তির পথে চলো, কলহের পথে নয়।’