‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে মোদি কেন এত সরব, কংগ্রেসকে কেন করছেন আক্রমণ
এখন এটা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ যে আগামী বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন না থাকলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘বন্দে মাতরম’–এর সার্ধশত বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংসদীয় বিতর্কে উদ্যোগী হতেন না।
সোমবার দিনভর লোকসভায় এ নিয়ে যে বিতর্ক হয়ে গেল, তাতে পরিষ্কার, ওই নির্বাচনে জিততে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল কংগ্রেসের মুসলিম তোষণকেই হাতিয়ার করতে চাইছেন। চাইছেন, ‘বন্দে মাতরম’–এর ‘অঙ্গচ্ছেদ’–এর জন্য কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তুলে ধর্মীয় বিভাজন তীব্র করে তুলতে, যাতে পশ্চিমবঙ্গ নামক অ–বিজেপি দ্বীপটির দখল নেওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস হীনবল। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন দলের ‘মুসলিমপ্রীতি’ নিয়ে যেভাবে বিজেপি সরব, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও তাদের অভিযোগের চরিত্র এক।
কিন্তু তা করতে গিয়ে গত সোমবার বারবার তাঁদের শুনতে হয়েছে—‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে এত গদগদ হলেও ঘটনা হলো ওই গান রচনা ও সেই সম্পর্কিত বিতর্কে এই দলটির কোনো ভূমিকাই কখনো ছিল না। দেড় শ বছর আগে যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ওই গান রচনা করেছিলেন, তার ৫০ বছর পর বিজেপির আদর্শগত পূর্বসূরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) জন্ম।
শুধু তা–ই নয়, বিতর্ক শুরু করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বারবার নাজেহাল হলেন ওই গানের স্রষ্টাকে ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধন করে। কখনোবা স্বাধীনতাসংগ্রামী পুলিনবিহারী দাসকে বললেন ‘পুলিনবিকাশ দাস’, সূর্য সেনকে ‘মাস্টারদা’ অভিহিত না করে বললেন ‘মাস্টার’। এই কারণে বাংলা ও বাঙালিকে অপমান করার অভিযোগে তাঁকে বিদ্ধ হতে হলো। বারবার শুনতে হলো, স্বাধীনতাসংগ্রামে যাঁদের তিলমাত্র অবদান ছিল না, যাঁরা কোনোকালে ‘বন্দে মাতরম’ বলেননি, সংঘের কোনো শাখায় কখনো যাঁরা ‘বন্দে মাতরম’ গাননি, তাঁরাই আজ সরব।
গত সোমবারেই প্রথম শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় প্রবেশ করামাত্র বিজেপি সদস্যদের মুখে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি। এভাবে মোদিকে স্বাগত জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি সদস্যরা স্লোগান দেন, বিহারের পর এবার বঙ্গজয়ের পালা।
বিজেপি কদিন ধরেই বলে আসছিল—‘বন্দে মাতরম’ বিতর্কে তারা বহু অজানা তথ্য তুলে ধরবে। বস্তুত, ‘অজানা’ তথ্য বলতে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য সদস্যরা যা বলেছেন, বিরোধীদের মতে তা ‘ইতিহাসের বিকৃতি’।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, গান্ধীজি চেয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম’–ই হোক দেশের জাতীয় সংগীত। কিন্তু ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘তুষ্ট’ করতে জওহরলাল নেহরুসহ কংগ্রেস নেতারা ‘বন্দে মাতরম’–এর পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলো বাদ দিয়েছিলেন এবং এই গানকে জাতীয় সংগীত হতে দেননি।
বিজেপিদলীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির অভিযোগ, কংগ্রেসের মুসলিম তোষণ সেই শুরু, যা শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কংগ্রেসকে তিনি আবার নতুন করে ‘মুসলিম লীগ–মাওবাদী কংগ্রেস’ বা ‘এমএমসি’ বলে অভিহিত করেন। কংগ্রেসকে এভাবে তিনি প্রথম পরিচিত করেছিলেন গত মাসে বিহার নির্বাচনের সময়।
‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে বিতর্ক ও ঐতিহাসিক সত্য ‘ইতিহাসের আলোয়’ তুলে ধরার কাজটুকু করেন কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র, গৌরব গগৈ, তৃণমূল কংগ্রেসের কাকলি ঘোষদস্তিদার, মহুয়া মৈত্র, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবেরা।
ইতিহাস তুলে ধরে এই নেতারা বলেন, ১৮৯৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’ প্রথম গাওয়া হয়েছিল এবং তা গেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘বন্দে মাতরম’–এর সুর সংযোজন করেছিলেন কবিগুরু। সেই থেকে ‘বন্দে মাতরম’–ই হয়ে ওঠে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূল স্লোগান। সেই স্লোগানে গোটা বাংলা মুখরিত হয়ে ওঠে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়।
মুসলিম ও জিন্নাহতুষ্টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব বিরোধীরা দিয়েছেন ইতিহাসের আলোয়। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের কাছে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার গুরু দায়িত্ব বর্তেছিল। সাম্প্রদায়িকতার বীজও বোনা হতে থাকে ১৯৩০ সাল থেকে। দ্বিজাতিতত্ত্ব তত দিনে বহু আলোচিত। এই সন্ধিক্ষণে ‘বন্দে মাতরম’–এর সর্বজনীনতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
জিন্নাহ ও মুসলীম লীগ প্রকাশ্যেই বন্দে মাতরম–এর বিরোধিতা শুরু করেন গানটির চতুর্থ স্তবক থেকে হিন্দু দেবী বর্ণনার কারণে। কংগ্রেসের কাছে সেটা ছিল এক সংকটময় পরিস্থিতি। ১৯০৫ সাল থেকে ‘বন্দে মাতরম’ প্রতিটি ভারতবাসীর ‘আত্মা’। ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান দিয়ে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করছেন স্বাধীনতাসংগ্রামীরা। সেই গান বর্জন করা অসম্ভব। আবার ধরে রাখলে ধর্মীয় বিভাজন দেশের একতাকে চুর্ণ করবে।
এই পরিস্থিতিতে উপায় বাতলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর নিদান ছিল, প্রথম দুটি স্তবক রেখে পরবর্তী স্তবকগুলো বর্জনের। সেটাই গৃহীত হয়েছিল, যা সমর্থন করেছিল দেশের সংবিধান পরিষদও।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম’–এর প্রথম দুই স্তবক লিখেছিলেন ১৮৭৫ সালে। সাত বছর পর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস লেখার সময় ওই গানে পরবর্তী চারটি স্তবক যোগ করেন। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেস অধিবেশনে গেয়েছিলেন ওই প্রথম দুটি স্তবকই।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র তারই উল্লেখ করে ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘নেহরুকে অপরাধী ঠাওরাতে গিয়ে আপনি দেশের সংবিধান পরিষদকেই অসম্মান করেছেন, যা বন্দে মাতরমকে ‘রাষ্ট্রীয় গানের’ মর্যাদা দিয়েছে। অসম্মান করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, আচার্য নরেন্দ্র দেব, বি আর আম্বেদকরদেরও—যাঁরা সংবিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বারবার নেহরুর সমালোচনা করেন। ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে বিতর্কেও তাঁর নিশানায় ছিলেন নেহরু ও কংগ্রেস। কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারা সোমবার সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে বলেছেন, আসল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই প্রধানমন্ত্রী ‘বন্দে মাতরম’–এর মতো বিষয় টেনে এনেছেন। তিনি ভাবেন, এভাবে মানুষকে ভুলিয়ে রাখা যাবে।
প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র বলেন, মূল্যবৃদ্ধির ছেঁকায় মানুষ জ্বলছে, দূষণে হাঁসফাঁস করছে, বেকারত্বের জ্বালা মানুষকে বিচলিত করছে, এসআইআরের ঠেলায় বিএলওরা আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু মোদির হুঁশ নেই। তিনি ব্যস্ত হিন্দু–মুসলিমের বিভাজন সৃষ্টিতে। ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টিতে।
প্রিয়াঙ্কাও ছেড়ে দেননি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি মাস কয়েক আগে একটি তালিকা দিয়েছিলেন। তাতে কতবার আপনাকে অপমানিত হতে হয়েছে তার উল্লেখ ছিল। বলেছিলেন, আপনাকে বিরোধীরা নাকি ৯৯ বার গালি দিয়েছে। সেই রকম আর একটা তালিকা আপনি তৈরি করুন। জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগগুলো তাতে লিখুন। নেহরু কতবার কী কী ভুল করেছেন, কীভাবে দেশের সর্বনাশ করেছেন সব লিপিবদ্ধ করুন। সেই তালিকায় ৯৯৯টি তথ্যও থাকতে পারে। তারপর সেসব সংসদে আলোচনার জন্য নিয়ে আসুন।’
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রিয়াঙ্কা আরও বলেন, ‘আজ যেমন “বন্দে মাতরম” নিয়ে ১০ ঘণ্টা আলোচনা হচ্ছে, তেমনই নেহরুকে নিয়ে ১০, ২০ কি ৪০ ঘণ্টা যত সময় লাগে আলোচনা করুন। নেহরুর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আলোচনা করে চিরকালের মতো ক্ষান্ত হোন। নেহরু কী করেছেন, ইন্দিরা কী করেছেন, রাজীব কী করেছেন—দয়া করে সব সমালোচনা চিরকালের মতো করে ফেলুন। তারপর আসুন আমরা আলোচনা করি বেকারত্ব নিয়ে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে, নারী নির্যাতন নিয়ে, জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে—যেগুলো সংসদে আসতে দেওয়া হয় না।’