দিল্লির রাস্তায় পদ্মশ্রী পদক রেখে এলেন প্রতিবাদী কুস্তিগির

দিল্লি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগত ও বজরং পুনিয়া। ২১ ডিসেম্বরছবি: এএনআই

অলিম্পিকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদকজয়ী কুস্তিগির সাক্ষী মালিক ক্ষোভ–দুঃখ–অভিমানে গত বৃহস্পতিবার খেলা থেকে অবসর নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। পরদিন গতকাল শুক্রবার সতীর্থ কুস্তিগির বজরং পুনিয়া ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব ছেড়ে এলেন রাজধানীর কর্তব্যপথে (সাবেক রাজপথ)। তবু বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই কেন্দ্রীয় সরকার অথবা শাসক দলের। জাতীয় কুস্তি সংস্থার নির্বাচনী ফল ঘিরে কুস্তিগিরদের অভিনব প্রতিবাদ নিয়ে কেউ একটি মন্তব্যও করেননি। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু বলা হয়েছে, সরকারের দেওয়া সম্মান কেউ এভাবে ফেরত দিতে পারেন না।

মূল বিতর্ক অনেক দিনের পুরোনো। ভারতের জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন উত্তর প্রদেশ থেকে নির্বাচিত বিজেপির লোকসভা সদস্য ব্রিজভূষণ শরণ সিং। তাঁর বিরুদ্ধে নারী কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্তা করার অভিযোগে প্রতিবাদী হয়েছিলেন সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগত, সংগীতা ফোগত, অংশু মালিক, বজরং পুনিয়াদের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদকজয়ী কুস্তিগিরেরা।

সুবিচারের আশায় প্রথমে গত বছর কুস্তিগিরেরা দিল্লির রাস্তায় ধরনা দিয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের আশ্বাসে তা তুলে নেন। কয়েক মাস পরেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁরা আবার আন্দোলন শুরু করেন। দিল্লিতে ধরনা দেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁদের দাবি ছিল, সংস্থার সভাপতি ব্রিজভূষণের অপসারণ ও গ্রেপ্তার এবং তাঁর সংসদ সদস্য পদ খারিজ।

তবে কুস্তিগিরদের দাবির পরও সরকার বা বিজেপি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। বরং গত ২৮ মে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের দিন কুস্তিগিরদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে না দিয়ে দিল্লি পুলিশ তাঁদের জবরদস্তি গ্রেপ্তার করেছিল।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে। দিল্লির নিম্ন আদালতে সেই বিচার এখনো শেষ হয়নি। একাধিক নারীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ সত্ত্বেও ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। যদিও জাতীয় কুস্তি সংস্থার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে তিনি বাধ্য হন। নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও রীতিমতো ঘোষণা করে ব্রিজভূষণ সভাপতি পদে দাঁড় করান তাঁরই ঘনিষ্ঠ অনুচর সঞ্জয় সিংকে।

ব্রিজভূষণের প্রার্থীর বিপক্ষে প্রার্থী হন কুস্তিগিরদের পছন্দের কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী নারী অনিতা শেওরান। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, ব্রিজভূষণের অনুগামীদেরই রমরমা। অনিতা পেয়েছেন মাত্র ৭ ভোট, সঞ্জয় ৪০। ফল ঘোষণার পরই ব্রিজভূষণের দাপাদাপি দেখা যায়। তাঁকে মালা পরিয়ে বরণ করে নেন তাঁর অনুগামীরা। সদর্পে জানান, বকলমে ফেডারেশন চালাবেন ব্রিজভূষণই।

ফল প্রকাশের পরই গত বৃহস্পতিবার প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়ায় ডাকা সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়েন পদকজয়ী কুস্তিগিরেরা। কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষী মালিক বলেছিলেন, ‘৪০ দিন আমরা রাস্তায় কাটিয়েছি। ক্রীড়ামন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, অপরাধীর শাস্তি হবে। শাস্তি এখনো কেউ পায়নি। ফেডারেশনও অভিযুক্তের হাত থেকে মুক্ত হলো না। ব্রিজভূষণের সহযোগী ও ব্যবসার অংশীদার সভাপতি হলেন। অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে যে অনাচার চলে আসছে, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমি তাই আজই অবসর নিচ্ছি।’

অবসরের ঘোষণা দেওয়ার কথা বলেই কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষী তাঁর কুস্তির জুতা জোড়া টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলেন।

গতকাল শুক্রবার বজরং পুনিয়া কর্তব্যপথে আসেন পদ্মশ্রী খেতাব নিয়ে। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠি। কর্তব্যপথ ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে যেতে গেলে পুলিশ তাঁকে বাধা দেয়। অলিম্পিক পদকজয়ী বজরং রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে পড়েন। সেখানেই রেখে দেন পদ্মশ্রী খেতাব ও চিঠি। দিল্লি পুলিশ তা তুলে নেয়।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা চিঠিতে নিজেকে ‘অসম্মানিত পালোয়ান’ আখ্যা দিয়ে পুনিয়া বলেন, ‘সরকারি আচরণে হতাশ হয়ে আমরা হরিদ্বারের গঙ্গায় পদক ভাসাতে গিয়েছিলাম। আপনার এক দায়িত্বশীল মন্ত্রী ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়ে আমাদের ফিরিয়েছিলেন। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনিও সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ফেডারেশন থেকে ব্রিজভূষণ, তাঁর আত্মীয় ও সাঙ্গপাঙ্গদের বের করে দেবেন। কিন্তু সেই ব্রিজভূষণের হাতেই ২১ ডিসেম্বর ফেডারেশনের ক্ষমতা ফের চলে গেল।’

সঞ্জয় জেতার পর ব্রিজভূষণ সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, ফেডারেশনে তিনিই ছিলেন শেষ কথা, সেটাই জারি থাকবে। তাঁর কর্তৃত্ব অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে।

যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠা একজন ব্যক্তি কীভাবে এমন করতে পারেন ও সরকারই–বা কীভাবে নীরব থাকতে পারে, চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে সেই প্রশ্ন করে বজরং লিখেছেন, ‘মহিলা কুস্তিগিরদের অপমান ও অসম্মানের পর আর সম্মানিত খেতাব বইতে পারব না। তাই পদ্মশ্রী খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছি।’

কংগ্রেস নেতা ও অলিম্পিক সোনাজয়ী বক্সার বিজেন্দ্র সিং এই ঘটনাপ্রবাহ ও সাক্ষীর অবসর গ্রহণের ঘোষণাকে ‘দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের কালো দিন’ বলেছেন। কংগ্রেসসহ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকেরা প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানকে কটাক্ষ করে বলেছে, খ্যাতিমান নারীদের যেখানে এই হাল, সেখানে সাধারণের অবস্থা কতটা শোচনীয়, তা সহজেই অনুমেয়।

গত শুক্রবার সাক্ষীর বাড়ি গিয়ে একই কথা বলেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সেখানে তিনি বলেন, বিজেপি একজন অলিম্পিক পদকজয়ী কৃষককন্যাকে কুস্তি ছাড়তে বাধ্য করল। মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্তার গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মোদি সরকার বিজেপির সংসদ সদস্য ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিল না। এ শুধু নারী সমাজের অপমানই নয়, দেশের লজ্জা।

সরকার বা বিজেপি এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সরকারি সূত্রের মতে, এভাবে সরকারি খেতাব ফেরত দেওয়া যায় না। অতীতে অনেকেই এই কাজ করেছেন। তাঁদের নাম কিন্তু এখনো সরকারি খাতায় পদকপ্রাপ্ত হিসেবে জ্বলজ্বল করছে।