খ্রিষ্টানদের ওপর হামলার নিন্দায় ভারতের দুই প্রভাবশালী দৈনিক, মোদি–বিজেপি নীরব

ভারতের বিহারে ক্যাথলিক গির্জায় শিশু জেসাসকে চুমু দিচ্ছেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের এক নারী। ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, পাটনাছবি: এএনআই

বড়দিন উদ্‌যাপন উপলক্ষে ভারতজুড়ে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা নিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আজ শনিবারেও নীরব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে এখনো মুখ খোলেননি। তবে প্রথম সারির সর্বভারতীয় দৈনিকগুলো মুখ খুলেছে। সম্পাদকীয় স্তম্ভে গুন্ডাদের শাস্তির দাবি জানানোর পাশাপাশি লেখা হয়েছে, স্বঘোষিত ধর্মপ্রহরীদের দাপাদাপি বন্ধ করা প্রয়োজন।

বড়দিন উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লির এক গির্জায় প্রার্থনা জানান। প্রার্থনা শেষে সামাজিক মাধ্যমে শান্তি, ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছার বার্তা দেন। অথচ তার আগের দিন থেকে বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হানতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা অগ্রাহ্য করে বড়দিনের দিনেও হামলা অব্যাহত থাকে।

বিস্ময় এই যে ভারতজুড়ে ওই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত একটি কথাও বলেননি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিজেপিও ঘটনাপ্রবাহের নিন্দা করে কোনো বিবৃতি প্রচার করেনি। শুধু মধ্যপ্রদেশ বিজেপির জব্বলপুর শাখা দলের অন্যতম নেত্রী অঞ্জু ভার্গবকে একটি চিঠি দিয়ে বলেছে, তাঁকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে।

মধ্যপ্রদেশের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বড়দিন উদ্‌যাপন উপলক্ষে এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী খ্রিষ্টান নারীর সঙ্গে অঞ্জু দুর্বব্যহার করছেন।

চলতি বছর বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দেশজুড়ে যেভাবে বড়দিন উদ্‌যাপনের বিরোধিতা করেছে, অতীতে তা হয়নি। বিজেপিশাসিত রাজ্য আসাম, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ওডিশা এবং দিল্লির পাশাপাশি বামশাসিত রাজ্য কেরালা ও আম আদমি পার্টি শাসিত (আপ) পাঞ্জাবে এই দুই সংগঠনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘও (আরএসএস) বড়দিন উদ্‌যাপনের বিরোধিতা করেছে। বড়দিনের উৎসবে মেতে ওঠা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকেও বাধা দেওয়া হয়।

বিপণিবিতান থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোকানে বিক্রির জন্য রাখা ক্রিসমাস ট্রি, সান্তার টুপিসহ অন্য সামগ্রীতে আগুন ধরিয়ে দেয় হিন্দুত্ববাদীরা। গির্জায় ঢুকে ক্যারল গাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া ও দ্য হিন্দুস্তান টাইমস উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আজ শনিবারের কাগজে সম্পাদকীয় লিখেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয়র শিরোনাম ‘পানিশ দ্য গুনস্, হোয়াই বিজেপি শুড রেসপন্ড স্ট্রংলি টু ক্রিসমাস অ্যাটাক্‌স’ এবং হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনাম ‘নো প্লেস ফর ফেথ ভিজিল্যান্টেস: অ্যাটেম্পটস টু ডিসরাপ্ট ক্রিসমাস সেলিব্রেশনস গো অ্যাগেইনস্ট ইন্ডিয়াস সিভিলাইজেশনাল ইথস’।

দেশজোড়া তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, বজরঙ্গ দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আচরণ ঘৃণ্য বেদনাদায়ক ও লজ্জার। তারা ক্রিসমাসের জন্য জমায়েত মানুষদের হয়রান করেছে। ক্যারল গাইয়েদের ভয় দেখিয়ে গান থামিয়েছে। স্কুল ও গির্জায় জবরদস্তি ঢুকে পড়েছে। সান্টা ক্লজের টুপি বিক্রেতা গরিব মানুষদের মারধর করেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, কেরালা ছাড়া আর কোথাও পুলিশ কি এই অপরাধ নজরে এনেছে? ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৯৬(২) ও ২৯৯ ধারায় এফআইআর দাখিল করেছে, যে ধারায় মানুষে মানুষে শত্রুতা বাড়ানো বা ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে? ভিডিও দেখে যাদের সহজেই শনাক্ত করা যাচ্ছে, তাদের কাউকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? এরা সবাই উৎসবের সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের জন্য দায়ী।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিজেপি ও আরএসএসকে এই জঙ্গিপনা বন্ধ করতে হবে। এরা শুধু দলের ক্ষতিই করছে না, এরা হিন্দু বিরোধীও। ধর্মের নামে কোনো হিন্দু এই বর্বরতা অনুমোদন করে না। ইউনাইটেড ক্রিশ্চান ফোরাম অভিযোগ জানিয়েছে, এই বছর বড়দিনের সময় সারা দেশে এমন ধরনের ৬০০–এর বেশি ঘটনা ঘটেছে। গুন্ডাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। একটি ছাড়া সব কটি রাজ্যই বিজেপিশাসিত। দলটি দেশেরও শাসক। এতে বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই কারণে আরও বেশি করে বিজেপি নেতৃত্বের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার তুলনায় হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাকদীয় দীর্ঘ। প্রধানমন্ত্রীর গির্জায় যাওয়া, প্রার্থনা করা এবং সম্প্রীতির বার্তা দেওয়ার উল্লেখের পর তারা লিখেছে—আসাম ও ছত্তিশগড়ে সংঘ পরিবারের ধর্মপ্রহরীরা কীভাবে বড়দিনের আগে থেকেই খ্রিষ্টানদের হয়রান করেছে, উদ্‌যাপন বানচাল করেছে।

মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারীকে বিজেপি নেত্রীর হেনস্তা করার ভিডিওটি বিরক্তিকর জানিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ছত্তিশগড়ে বড়দিনের দিন বন্‌ধ্‌ পালনের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী প্রহরীরা ভয়ের যে বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল, যা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, সেটার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলে মত দেয়। শুধু আইনগতভাবে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশেরও কম। প্রধানত উত্তর–পূর্বাঞ্চল ও কেরালায় তাদের অবস্থান জানিয়ে উপসম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, সংবিধান সবাইকে বাধাহীন ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিয়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে ধর্মান্তরণ বিরোধী কোনো আইন নেই। কোনো কোনো রাজ্য এই সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেছে, জবরদস্তি অথবা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরণ বন্ধ করতে। ধর্মপ্রহরীরা সেই আইনকেই হাতিয়ার করে অহিন্দুদের হেনস্তা করছে।

সম্পাদকীয়তে বলা হয়, রাষ্ট্রের উচিত এই ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি রাজনৈতিক দিক থেকেও সক্রিয় হওয়া জরুরি, যাতে কেউ লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম না করে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতের প্রলেপ হবে।

সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, বিজেপির বোঝা উচিত, ধর্মপ্রহরীরা তাদের ক্ষতি করছে। বিজেপি নেতৃত্বের বোঝা উচিত এদের প্রশ্রয় দিলে সম্প্রীতির জন্য দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বার্তা বিফলে যাবে। ভারতীয় সভ্যতার মূল মন্ত্র ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’, যার অর্থ—গোটা পৃথিবীই এক পরিবার।