টানা ৩০ দিন জেলে থাকলেই মন্ত্রিত্ব শেষ, ভারতের লোকসভায় নতুন বিল
টানা ৩০ দিন জেলে থাকলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অথবা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের অপসারিত হতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার আজ বুধবার ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভায় এই মর্মে একটি বিল পেশ করেছে। বিলের মোদ্দা বিষয়, যে অপরাধের শাস্তি অন্তত পাঁচ বছরের জেল তেমন কোনো অপরেধের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্র, রাজ্য কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মন্ত্রী কাউকে যদি টানা ৩০ দিন জেলে থাকতে হয়, তা হলে তাঁকে পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে। রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালদের সেই ক্ষমতা দেওয়া হবে।
বিরোধীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজ দুপুরে লোকসভায় এই সংবিধান সংশোধন বিল পেশ করেন। বিলটি পেশের পর তিনি তা আরও বিবেচনার জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এটি হলো সংবিধানের ১৩০তম সংশোধন বিল। সংবিধান সংশোধন বিল পাস করাতে সংসদের উভয় কক্ষে দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। লোকসভা ও রাজ্যসভায় এখনো সরকার ও তাদের সহযোগী দলগুলোর দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।
বিরোধীরা সম্মিলিতভাবে এই বিল পেশে বাধা দেন। তাঁরা সভার ‘ওয়েলে’ নেমে এসে সমস্বরে প্রতিবাদ জানান। কোনো কোনো সদস্য বিলের কপি ছিড়ে সভাকক্ষে উড়িয়েও দেন। কিন্তু তাতে বিল পেশ আটকানো যায়নি। প্রবল হট্টগোলের মধ্যে বিলটি পেশ হয়ে যাওয়ামাত্র সভা মুলতবি করে দেওয়া হয়। আগামী কাল বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশনের শেষ দিন।
কোন তাগিদে এই বিল, তা এখনো অনেকের বোধগম্য নয়। সরকারের দাবি, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে তোলাই এর লক্ষ্য। সরকারের দাবি মানতে বিরোধীরা রাজি নয়। বিরোধী নেতারা প্রত্যেকেই এই বিলকে ‘আরও এক কালাকানুন’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বিরোধী স্বর দমানো, বিরোধীদের সরকার ভাঙা এই বিলের লক্ষ্য। কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি, কে সি বেনুগোপাল, এআইএমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়েইসিসহ প্রত্যেকেই বলেন, এই বিল সংবিধান, ন্যায়বিচার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী।
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, এই বিল পাস হলে ভবিষ্যতে যেকোনো মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হবে। টানা ৩০ দিন জামিন না দিয়ে জেল হেফাজতে রেখে দেওয়া হবে। ৩১ দিনের মাথায় তাঁকে বরখাস্ত করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বরখাস্ত হলে গোটা মন্ত্রিসভারই পতন ঘটবে। বিলটি পাস হলে এটা শুধু বাজে আইনই হবে না, এটা আরও এক নির্ভেজাল কালাকানুন হিসেবে পরিচিত হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার হিটলারি কায়দায় গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানতে চাইছে। আজ বিল পেশের পরেই ‘এক্স’ হ্যান্ডলে এক পোস্টে তিনি লেখেন, সুপ্রিম কোর্ট যাদের খাঁচায় বন্দী তোতা বলেছিলেন, সেই ইডি-সিবিআইয়ের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধসিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একমাত্র ক্ষমতাবান করার চেষ্টা হচ্ছে। মমতা বলেন, এ বিলের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার অধিকার খর্বের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, যা চলছে, তা জরুরি অবস্থার চেয়ে ভয়ংকর।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আবগারি নীতি কেলেঙ্কারির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হলেও মুখ্যমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেননি। পাঁচ মাস জেলে কাটিয়ে জামিন পান। তার দিনকয়েক পর মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারেন। নতুন বিল আইনে পরিণত হলে ৩০ দিন জেলে থাকার পরদিনেই তাঁকে বরখাস্ত হতে হতো।
বিলটি আদৌ আইনসম্মত কি না, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হরণ করবে কি না, ন্যায়বিচারের ধারণার পরিপন্থী কি না—এসব প্রশ্ন অবশ্যই আদালতে বিবেচিত হবে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাই নির্দোষ। প্রচলিত আইনে চার্জশিট পেশ করার সর্বোচ্চ সময় ৯০ দিন। অথচ এই বিল অনুযায়ী, ৩০ দিন কাউকে কোনোভাবে জামিন না দিয়ে বন্দী রাখা গেলেই তাঁর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়া যায়। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক এম এ বেবি তাই বলেছেন, এটা বিজেপির নয়া ফ্যাসিবাদ। সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য জন ব্রিটাস বলেছেন, এটা বিরোধীদের সরকার ভাঙার আরও এক ছক।