পূর্ব ভারতে বাঙালিদের জন্য আরেকটি রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা

আসামের শিলচরের ভাষাশহীদ স্টেশন
ছবি: বিডিএফের সৌজন্যে

উত্তর-পূর্ব ভারতে এবার একটি বাঙালি-অধ্যুষিত রাজ্য গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেই রাজ্য হতে পারে আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার বাঙালি-অধ্যুষিত তিন জেলা নিয়ে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি এই প্রসঙ্গে দুটি পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে তিনি বলেছেন, দক্ষিণ আসামের বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার মানুষ যদি আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাজ্য গড়তে চান, তবে তাঁরা তা গড়তে পারেন। আবার একই সঙ্গে তিনি এ-ও বলেছেন যে জনগণকে ‘সম্মিলিতভাবে’ এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শুধু কয়েকজন নেতার ইচ্ছাতে বরাক আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।

মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে বাঙালিদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকারী বরাক উপত্যকার নাগরিক মঞ্চ বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (বিডিএফ)।

গত বৃহস্পতিবার বরাক উপত্যকা সফরকালে বিশ্বশর্মা বলেন, ‘জনগণ যদি আলাদা বরাক ভূমি চায়, তাহলে আমরা বিরোধিতা করব কেন? তবে জনগণকে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শুধু কিছু বামপন্থীর সিদ্ধান্তে এটা হবে না।’

কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হালিয়াকান্দি জেলাগুলোকে ঘিরে বরাক উপত্যকাকে আলাদা করার দাবি ওঠে ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসের পরবর্তী পর্যায়ে। এপ্রিল মাসে আসামে অহমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকার স্বীকৃত ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব আসে। ওই বছরের অক্টোবরে রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব বিল আকারে পাস হয়। এই আইনের জেরে বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় আন্দোলন শুরু করেন সেখানকার মানুষ, যার ফলে ১৯৬১ সালের ১৯ মে  সেখানে গুলি চলে এবং মারা যান মোট ১১ জন। দিনটিকে বরাক উপত্যকায় ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। সেখানে সব সময়ই এই আন্দোলনকে ১৯৫২ সালের বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই আন্দোলনের জেরে অহমিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলাও সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা
এএনআই ফাইল ছবি

বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তের কারণে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড। বরাক উপত্যকার তিন জেলার পূর্ব দিকে রয়েছে মণিপুর। যেখানে গত চার মাসেরও বেশি সময় তীব্র জাতিবাদী সংঘাত চলছে। বরাকের দক্ষিণে রয়েছে মিজোরাম ও ত্রিপুরা, পশ্চিমে বাংলাদেশ এবং উত্তরে নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়।

সম্প্রতি এই অঞ্চলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আবার মাথাচাড়া দিয়েছে অন্য কারণে। কারণটি রাজনৈতিক। ভারতের নির্বাচন কমিশন জুলাই মাসে আসামের ১২৬ সদস্যের বিধানসভা এবং ১৪টি লোকসভা আসনের সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়া, যাকে ‘ডিলিমিটেশন বলা হয়, চূড়ান্ত করেছে। এর ফলে বরাক উপত্যকার তিন জেলায় বিধানসভা আসন ১৫ থেকে ১৩ হয়ে যায়। প্রধান বিরোধী কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বাম দল, এমনকি আসামে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারাও আসন কমানোর বিরোধিতা করেন। কিছুদিন আগে বরাক উপত্যকায় ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ্‌ও পালন করা হয়।

এই রকম একটা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বিশ্বশর্মা বলেন, মানুষ চাইলে পৃথক রাজ্যের দাবিকে মেনে নিতে তাঁর আপত্তি নেই। অবশ্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এমন দাবিও করেন যে বরাক উপত্যকার মানুষ ‘ডিলিমিটেশনের প্রক্রিয়ায়’ অত্যন্ত সন্তুষ্ট।

বিডিএফের মুখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্তরায়
ছবি: বিডিএফের সৌজন্যে

মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা বলেন, ‘আমি মানুষের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পেয়েছি। জনগণ ডিলিমিটেশনের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত খুশি এবং আমাদের দল আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বরাকে ১৩টির মধ্যে অন্তত ১০টি আসন জিতবে।’ অঞ্চলের মানুষকে বিচ্ছিন্নতার দাবি উপেক্ষা করতে বলেন তিনি।

হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, ‘কিছু লোক আমাকে সব সময় বলে যে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই কেবল বরাকের বিচ্ছেদের কথা বলে। কিন্তু এখানকার বেশির ভাগ লোক একসঙ্গে বসবাস করতে চান। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমিও বিচ্ছেদ চাই না। আমরা সবাই ভাই ভাই। আমাদের এক সঙ্গেই থাকা উচিত।’

বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রতিক্রিয়া

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় বিডিএফ। এক প্রেস বিবৃতিতে বিডিএফ বলে, ‘সাম্প্রতিক বরাক সফরে এসে রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন যে বরাকের জনগণ চাইলে পৃথক্‌করণের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি নেই। তবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি চান, এই উপত্যকা আসামের সঙ্গেই থাকুক। পৃথক্‌করণকে এভাবে পরোক্ষ সমর্থন জানানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন।’

বিডিএফের মুখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্তরায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ডিলিমিটেশন’ মাধ্যমে “বরাকের ৪২ লাখ বাসিন্দার জন্য বরাদ্দ হলো বিধানসভার ১৩টি আসন, যেখানে ২৪ লাখ জনসংখ্যার বোড়োল্যান্ডের জন্য আসন সংখ্যা ১২ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হলো।” এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে বন্‌ধ্‌ ডাকা হয়েছিল, তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন আপামর বরাকবাসী’, বলেন দত্তরায়।

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখভাগ
ছবি: বিডিএফের সৌজন্যে

আগামী কিছুদিনের মধ্যে পৃথক রাজ্যের ইশতেহার ও প্রচার পুস্তিকা জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলেও জানান বিডিএফ মিডিয়া সেলের মুখ্য আহ্বায়ক জয়দীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে পৃথক্‌করণের দাবিতেও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাওয়া যাবে। সবে এক মাস হলো বিডিএফ পৃথক্‌করণের ডাক দিয়েছে। এখনো প্রচার পর্বই শুরু হয়নি। কিন্তু ইতিমধ্যেই এ নিয়ে বরাকজুড়ে সাড়া পড়েছে। অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগাযোগ করছেন। এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এই ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।’

বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের বিভিন্ন অভিযোগ

প্রদীপ দত্তরায় বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্টীকরণের জন্য কয়েকটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে বলে সরকার দাবি করেছে। এর মধ্যে বরাক থেকে কতজন চাকরি পেয়েছেন, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কোনো জবাব দেননি।

প্রদীপ দত্তরায় বলেন, ‘একটি সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি যে বরাক থেকে এক হাজার নিযুক্তিও হয়নি। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী জবাব দেননি, তাই ধরে নিতে হবে এই তথ্যই সঠিক।’

এ ছাড়া রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ বাংলাভাষীর মাতৃভাষাকে সরকারি সহযোগী ভাষার মর্যাদা কেন দেওয়া হচ্ছে না, কেন ‘ভাষাশহীদ’ স্টেশন নামকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না বা বিদ্যুৎ বণ্টনে বরাককে বঞ্চনা করা হচ্ছে, স্থানীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়। এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি বলে বিডিএফের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।