আবারও রক্ত ঝরল কাশ্মীরে

কাশ্মীরে ভারতের নিরাপত্তাকর্মীদের অবস্থান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কাশ্মীরে আজ বৃহস্পতিবারও রক্ত ঝরল। সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হলেন এক ব্যাংক ম্যানেজার। নাম বিজয় কুমার। তিনি রাজস্থানের বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার ভোরে এক বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন তিন সেনাসদস্য। তাঁদের একজনের অবস্থা গুরুতর। কাজের জন্য কাশ্মীরে থাকা হিন্দুদের ওপর নতুন করে আক্রমণ শুরু হওয়ার ঘটনার সামাল কীভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

উপত্যকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য শুক্রবার উচ্চপর্যায়ের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাতে যোগ দিতে দিল্লি আসতে বলা হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল মনোজ সিনহাসহ কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলের নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত পদস্থ কর্তাদের।

তার আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে অমিত শাহ বৈঠক করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে। সেই বৈঠকে জম্মুর রাজনীতিক ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংও উপস্থিত ছিলেন।

১৫ দিন আগেও এমন ধরনের সরকারি আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন অমিত শাহ। উপলক্ষ ছিল অমরনাথ যাত্রা। ৩০ জুন থেকে শুরু হচ্ছে এ যাত্রা, চলবে ১১ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু উপত্যকার নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঠুনকো, তা বোঝা যাচ্ছে একের পর এক ‘বাছাই হত্যা’র ঘটনায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে—এই পাঁচ মাসে উপত্যকায় ১৮ জন মারা গেছেন সন্ত্রাসীদের হামলায়। অধিকাংশই কাশ্মীরি পণ্ডিত। কয়েকজন বিহার, উত্তর প্রদেশের হিন্দু শ্রমিক।

তিন দিন আগে স্কুলশিক্ষিকা রজনী বালা খুন হন। ৭২ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম জেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলেন ব্যাংক ম্যানেজার বিজয় কুমার। রজনী বালার মতো এটিও ‘বাছাই হত্যা’। ভারতের মরুরাজ্য রাজস্থানের হনুমানগড় এলাকার বাসিন্দা বিজয় কুমার মাত্র কদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তিন দিনের ব্যবধানে দুজনেই খুন হলেন কুলগাম জেলায়। পাশের জেলা শোপিয়ানে বৃহস্পতিবার ভোরে এক গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটায় সেনাবাহিনীর তিন জওয়ান আহত হন। সেনাসূত্র জানিয়েছে, একজনের আঘাত গুরুতর। অন্য এক ঘটনায় ফারুক শেখ নামের এক ব্যক্তি আহত হন। পুলিশ জানায়, এটি ছিল ‘বাছাই আক্রমণ’।

শিক্ষিকা হত্যার ঘটনার আগে থেকেই উপত্যকায় কর্মরত হিন্দু সরকারি কর্মীরা নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকারি উদ্যোগে পণ্ডিতদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নেওয়া হয়েছিল। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হলো ঘরছাড়া পণ্ডিতদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান তৈরি। বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়। তাঁদের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কাজের ব্যবস্থাও করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে প্রায় চার হাজার পণ্ডিত বসবাস শুরু করেন উপত্যকার বিভিন্ন জেলায়। তাঁদের মধ্যে আড়াই হাজারের কিছু বেশি পণ্ডিত উপত্যকায় গেছেন নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর।

চলতি বছর ‘বাছাই হত্যা’ নতুনভাবে শুরু হওয়ায় এই পণ্ডিতদের অনেকে কাজ ছেড়ে জম্মু ফিরে গেছেন। যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁরা দুই সপ্তাহ ধরে শ্রীনগরের বিভিন্ন স্থানে নিত্য বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিক্ষোভ জোরালো হয়েছে গত মাসে বদগাম জেলার ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে রাহুল ভাট নামের এক পণ্ডিত নিহত হওয়ার পর। পণ্ডিতদের দাবি, উপত্যকা থেকে তাঁদের সরিয়ে জম্মুসহ অন্যত্র নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হোক।

শিক্ষিকা রজনী বালা নিহত হওয়ার পর উপত্যকার পণ্ডিতেরা সরকারি চাকরি থেকে গণ–ইস্তফার হুমকি দেন। গত বুধবার উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা তাঁদের দাবি মেনে নেন। সরকারিভাবে জানানো হয়, পণ্ডিতদের দ্রুত নিজেদের জেলা সদরে বদলি করা হবে। আগামী সোমবারের মধ্যে ওই কাজ সেরে ফেলার কথা।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলে, উপত্যকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় এ বছর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন তারা এবার নির্বিচার খুন করছে না। তারা প্রধানত সেই হিন্দুদের মারছে, যাঁরা কাশ্মীরি পণ্ডিত, একসময় উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়ে সরকারি সাহায্যে ফিরে এসে সরকারি নিরাপত্তায় থেকে সরকারি প্রকল্পে যোগ দিয়েছেন। এ প্রকল্পগুলোতে রয়েছে সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও সরকারশাসিত সংস্থা। পাশাপাশি মারা হচ্ছে তাঁদের, সন্ত্রাসীরা যাঁদের বিভিন্ন কারণে সন্দেহের চোখে দেখে।

সূত্রটির মতে, এই ‘টার্গেটেড কিলিং’ বা বাছাই হত্যার একমাত্র উদ্দেশ্য বিশেষ করে পণ্ডিতদের মনে ভয়ের সঞ্চার ঘটিয়ে সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ প্রমাণিত করা। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পর সরকার ‘কাশ্মীর স্বাভাবিক’ বলে যে প্রচার চালাচ্ছে, তা ব্যর্থ করা।

দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি কৌশলগত। সন্ত্রাসীরা এবার এমন কোনো কাজ করছে না, যাতে সাধারণ কাশ্মীরি মানুষের রুজিরোজগার ব্যাহত হয়। পর্যটকেরা ভয় পান, এমন কোনো কাজও তারা এবার করেনি। চলতি মৌসুমে কাশ্মীরে রেকর্ডসংখ্যক পর্যটক গেছেন। বাছাই হত্যা সত্ত্বেও পর্যটক যাত্রা অব্যাহত। সূত্রটির মতে, পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষতি না করার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীরা সম্ভবত সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে চায়। গোয়েন্দারা মনে করছে, এটা তাদের কৌশলগত পরিবর্তন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাংশের ধারণা, কাশ্মীর বিধানসভার নির্বাচনের আগে সন্ত্রাসী হামলার তীব্রতা বেড়ে যাবে। তারা যে ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, তা শুধু উপত্যকাতেই নয়, জম্মু এলাকাকেও ছড়াচ্ছে। সূত্রটি বলে, শাসক বিজেপির কাশ্মীর নীতি ভ্রান্ত প্রমাণ করা ‘বাছাই হত্যার’ অন্যতম লক্ষ্য। এতে হিন্দুপ্রধান জম্মুতেও শাসক বিজেপির প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। বাছাই হত্যা নিয়ে সরকারকে আক্রমণ করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তাঁর টুইট, সরকার ধুমধাম করে অষ্টম বর্ষপূর্তির উৎসব করছে সেই সময়, যখন গত পাঁচ মাসে ১৮ জন নাগরিক ও ১৫ জন নিরাপত্তারক্ষী কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। রাহুল লিখেছেন, এটা সিনেমা নয়। এটাই বাস্তবের কাশ্মীর।