ইন্টারনেট বন্ধে এগিয়ে ভারত

প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারি ও লকডাউন ২০২০ সালের বড় একটি সময়জুড়ে বিশ্ববাসীকে কার্যত ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। এ সময় বাড়ি থেকে অফিস করেছেন অনেকেই। শিশুরা অনলাইনে ক্লাস করেছে। সদাইপাতি থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক নানা কাজে নির্ভর করতে হয়েছে অনলাইনের ওপর। স্বাভাবিকভাবে মহামারির সংকটময় সময়ে ইন্টারনেটের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা ও এর ব্যবহার—দুটিই বেড়েছে। এর মধ্যেও অনেক দেশ ব্যবহারকারীদের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে কিংবা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিয়েছে। আর এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ভারত।

বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল মাধ্যমে অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করে অ্যাক্সেস নাও। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালে ২৯ দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি কিংবা আংশিক বন্ধ ও ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখার ১৫৫টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভারতেই ঘটেছে ১০৯টি ঘটনা।

এ ছাড়া ইয়েমেনে ছয়টি, ইথিওপিয়ায় চারটি, জর্ডানে তিনটি, বেলারুশ, চাদ, গিনি, কেনিয়া, পাকিস্তান, সুদান, টোগো ও ভেনেজুয়েলায় দুটি করে ঘটনার কথা জানিয়েছে অ্যাক্সেস নাও। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গত বছর আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, আজারবাইজান, কিউবা, বুরুন্ডি, ইকুয়েডর, মিসর, ইরান, ইরাক, কিরগিস্তান, মালি, মিয়ানমার, তানজানিয়া, সিরিয়া, উগান্ডা, তুরস্ক ও ভিয়েতনামে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ কিংবা গতি কমিয়ে রাখার একটি করে ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিষ্ঠানটির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নীতিবিষয়ক পরিচালক রমন জিৎ সিং চিমা বলেন, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের মাধ্যমে সরকারগুলো জনগণের গণতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ রোধের চেষ্টা করেছে। এমনকি মহামারির সংকটময় সময়ে যখন মানুষ ঘরে বন্দী ছিল, তখনো বিভিন্ন দেশের সরকার এ ব্যাপারে তৎপর ছিল।

শীর্ষে ভারত
২০২০ সালে ভারতে ইন্টারনেট বন্ধের ১০৯টি ঘটনার কথা জানিয়েছে অ্যাক্সেস নাও। এর বেশির ভাগই ঘটেছে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। গত বছর কাশ্মীরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের ৯৬টি ঘটনা ঘটেছে। বাকি ১৩টি ঘটনা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য, রাজধানী দিল্লিসহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে ঘটেছে।

জম্মুর মডেল ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছন বাজিল্লাহ আইয়ুব। ২৪ বছর বয়সী এ শিক্ষার্থী বলেন, করোনা মহামারির কারণে অনলাইনে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়েছে। ১৫ মেগাবাইটের একটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে অনেক সময় এক-দুই ঘণ্টা লেগে যায়। ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় সময়মতো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

মূলত রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময় জম্মু-কাশ্মীরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে কিংবা গতি কমিয়ে রাখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ উপত্যকায় ইন্টারনেট পরিষেবা টানা বন্ধ ছিল। এ ঘটনাকে অসাংবিধানিক ও টেলিকম আইনের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন ঘিরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে নিরাপত্তার স্বার্থে রাজধানী দিল্লিতেও সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছিল ইন্টারনেট।

একই পথে এশিয়ার কয়েকটি দেশ
ভারতের মতো এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ গত বছর ইন্টারনেট বন্ধ কিংবা গতি হ্রাসের পথে হেঁটেছে। এ তালিকায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কিরগিজস্তান ও ভিয়েতনামের নাম উল্লেখ করেছে অ্যাক্সেস নাও। রাখাইনসহ কয়েকটি রাজ্যে সামরিক অভিযানের সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছিল মিয়ানমার। গত মাসের শুরুতে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান বিক্ষোভের রাশ টানতে একই কাজ করেছে জান্তা সরকার।

টানা ৪১৫ দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেটের গতি সীমিত রেখেছিল বাংলাদেশ সরকার, প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে অ্যাক্সেস নাও। রোহিঙ্গা স্টুডেন্টস নেটওয়ার্কের অভিযোগ, ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় মহামারিকালে অনলাইন থেকে স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত তথ্য পেতে সমস্যা হয়েছে।

বন্ধ ছিল ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে
গত আগস্টে সাধারণ নির্বাচন নিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, ভাইবার, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাময়িক বন্ধ রেখেছিল বেলারুশ সরকার। ৯-১২ আগস্ট দেশটিতে ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। নার্গানো-কারাবাখ সংকটে ছয় সপ্তাহের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ ও ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রেখেছিল আজারবাইজান সরকার।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে ইয়েমেনে ইন্টারনেট পরিষেবা সবচেয়ে বেশিবার বন্ধ হয়েছে। জানুয়ারিতে হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় ফাইবার অপটিক কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশটি ইন্টারনেট পরিষেবার ৮০ শতাংশ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।

গত বছর তিনবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছে জর্ডান। জুলাই-আগস্টে টিচার্স ইউনিয়নের বিক্ষোভের সময় ফেসবুক লাইভ বন্ধ রেখেছিল দেশটির সরকার। বিদায়ী বছরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ কিংবা গতি কমানো হয়েছিল তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, মিসর, আলজেরিয়াতে।

একই বৃত্তে আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা
জনপ্রিয় একজন সংগীতশিল্পীর হত্যাকাণ্ডের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ২০২০ সালে ইথিওপিয়াবাসী টানা দুই সপ্তাহ ধরে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেননি। সোমালিয়াভিত্তিক আল-শাবাহ গ্রুপের হামলায় টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেনিয়াতে বছরজুড়ে দুবার ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিক্ষোভ দমাতে টানা তিন দিন টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ সব ধরনের সামাজিক মাধ্যম বন্ধ রেখেছিল কিউবা। একই চিত্র দেখা গেছে ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডরে।

পেছনের কারণগুলো
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ কিংবা গতি কমিয়ে রাখার পেছনে গুজব ও ভুয়া খবরের লাগাম টানা, রাষ্ট্রীয় ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা বড় কারণ বলে জানিয়েছে সরকারগুলো। তবে এর পেছনে দেশে দেশে রাজনৈতিক মতবাদের বিস্তার রোধ, নির্বাচনকালীন সংকট এড়ানো, চলমান বিক্ষোভের রাশ টেনে ধরা, দাঙ্গা নিরসন, তথ্যের অবাধ প্রবাহে লাগাম টানাসহ বিভিন্ন কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে জানিয়েছে অ্যাক্সেস নাও। গত বছর ভারত, বেলারুশ, বুরুন্ডি, কিরগিস্তান, তানজানিয়াসহ অন্তত সাতটি দেশ জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছিল।