কৃষকমৃত্যু কত, সরকার তা–ও জানে না

কৃষক বিক্ষোভ
ছবি: রয়টার্স

অক্সিজেনের অভাবে দেশে কোভিডে আক্রান্তের মৃত্যুর সংখ্যা যেমন অজানা, কেন্দ্রীয় সরকার তেমন জানে না কতজন আন্দোলনকারী কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং টোমার সংসদে এই তথ্য জানিয়েছেন।

দিল্লির যন্তর মন্তরে অবস্থান বিক্ষোভরত কৃষকেরা মন্ত্রীর এই মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার কানে তুলা ও চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে। কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের মৃত্যুর তালিকা প্রতি সপ্তাহে দুইবার পরিবর্তিত হয়। কৃষি ও কৃষকদের বিষয়ে সরকার কতটা উদাসীন, মন্ত্রীর এই বিবৃতি তার প্রমাণ।


বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশের কৃষকেরা আট মাস ধরে আন্দোলন করছেন। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড ও হরিয়ানার কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছেন। এই আন্দোলনে মৃত্যু হওয়া কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সেই তালিকা প্রতি সপ্তাহে দুইবার পরিবর্তন করা হয়।

নতুন কারও মৃত্যু হলে তালিকায় তা ঢোকানো হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষিমন্ত্রী টোমার গত শুক্রবার সংসদে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সরকারের কাছে এই মৃত্যুর বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। পাশাপাশি তিনি এ কথাও জানান, তিন আইন নিয়ে কৃষকদের মনে কেন ও কী ধরনের আশঙ্কা বাসা বেঁধেছে, সে বিষয়ে সরকার কোনো গবেষণা বা জরিপ করেনি।

দিল্লির যন্তর মন্তরে চলছে কিষান সংসদ। ভারতীয় সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর দিন থেকেই কৃষকনেতারাও শুরু করেছেন তাঁদের কিষান সংসদ। সরকারি অনুমতি নিয়ে প্রতিদিন ২০০ কৃষকনেতা সেখানে উপস্থিত থাকেন। কৃষি আইন–সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের মনোভাবের সমালোচনা করেন। সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে সিপিএম নেতা ও সাবেক সাংসদ হান্নান মোল্লা শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সরকার কতটা অপদার্থ, কৃষিমন্ত্রীর বিবৃতিই তার প্রমাণ।

দিল্লি অবরোধ শুরু হওয়ার পর আন্দোলন করতে করতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের নামধাম, ঠিকানা ও পরিচয় সব তালিকায় তোলা আছে। একটা ব্লগ তৈরি করা হয়েছে। সপ্তাহে দুদিন তা বদলানো হয়। গত ৮ মাসে ৫৮২ জন আন্দোলনরত কৃষক মারা গেছেন। অথচ সরকার বলছে, তাদের কাছে কোনো হিসাব নেই।’ হান্নান মোল্লা বলেন, সরকার কখনো জানার চেষ্টাও করেনি। কতটা নির্দয় ও উদাসীন, সেই প্রমাণ সরকার তার আচরণে প্রকাশ করছে। এতজন অন্নদাতার মৃত্যু হলো, অথচ সংসদে একটা শোকপ্রস্তাব পর্যন্ত গৃহীত হলো না!

কেন্দ্রীয় সরকারের যোগ্যতা ও মানসিকতা নিয়ে কৃষকদের মতো নাগরিক সমাজেও প্রশ্ন উঠছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতী প্রবীণ পাওয়ার সম্প্রতি সংসদে যে বিবৃতি দিয়েছেন তার অর্থ, অক্সিজেনের অভাবে দেশে কোনো কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়নি। তিনি বলেন, কোনো রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পক্ষে এই বিষয়ে কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানো হয়নি। স্বাস্থ্য রাজ্য সরকারের বিষয়।

সরকারের এই মন্তব্য সারা দেশে অসন্তোষ ও বিস্ময় সৃষ্টি করে। তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় সরকারকে। গত এপ্রিল-মে মাসে দেশজুড়ে অক্সিজেনের হাহাকার দেখা দিয়েছিল। অক্সিজেনের অভাবে সর্বত্র মৃত্যুর মিছিল দেখা দিয়েছিল। অক্সিজেন পেতে কোনো কোনো রাজ্য সরকারকে আদালতের দ্বারস্থও হতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন আমদানি করতে হয়। নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। এত কিছু সত্ত্বেও কী করে সরকার সংসদে জানায় যে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই, তা বিভিন্ন মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

তবে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, কৃষকমৃত্যু বা অক্সিজেনের অভাবে কোভিড রোগীর মৃত্যুর তালিকা যেমন সরকারের কাছে নেই, তেমনি দেশজুড়ে প্রথম লকডাউনের সময় ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল সরকারের অজানা। গত বছর মার্চ মাসে প্রথম শুরু হয় তিন সপ্তাহের লকডাউন। সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাংওয়ার সংসদে জানিয়েছিলেন, সারা দেশে কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা কত শ্রমিক মারা গেছেন, তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই।

সাংসদদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, এমন কোনো তথ্য সরকার তৈরিও করে না। অথচ মার্চ মাসের সেই প্রথম লকডাউনে কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন, সেই হিসাব সরকার দিয়েছিল। মন্ত্রীর হিসাবে, সেই শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৫২। তাঁদের মধ্যে উত্তর প্রদেশের শ্রমিক ছিলেন সাড়ে ৩২ হাজার, বিহারের ১৫ হাজার। শুধু ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ভারতে কাজ হারিয়েছিলেন ১২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির তথ্য অনুযায়ী, সেই সময় বেকারত্ব ছিল ২৭ দশমিক ১ শতাংশ।