গুজরাটে রাহুল দেখাচ্ছেন ন্যায়ের স্বপ্ন

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।

একান্ত কথোপকথনের একটা কথা বলি। গোটা গুজরাটে কথাটা শাসক দলের নেতাদের মুখে মুখে ঘুরছে। গান্ধীনগরে পার্টির সদর দপ্তর ‘কমলম’ অথবা আহমেদাবাদ-আনন্দ-বরোদার কমল শোভিত দলীয় অফিসে আঞ্চলিক নেতাদের কাছে ভোটের সম্ভাব্য ফল সম্পর্কে জানতে চান, ওই কথোপকথন শুনতে পাবেন।

অমিত শাহকে নরেন্দ্র মোদি বলছেন, ‘ছাব্বিশে ছাব্বিশই আমার চাই। গতবার যেমন হয়েছিল। একটা আসনও হারানো মানে নিজের রাজ্যে সম্মান নিয়ে টানাটানি।’ অমিত শাহ জবাবে বলছেন, ‘পঁচিশটার গ্যারান্টি দিচ্ছি। ছাব্বিশটা উপহার দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব।’

কিন্তু এই কাল্পনিক কথোপকথন শোনানোর মধ্য দিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতারা এক অনাবিল আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন। ছাব্বিশের মধ্যে পঁচিশের অর্থ একটি মাত্র আসন নিয়ে সংশয়। পাঁচ বছর আগের মতো এটাও সেই ফাঁকা মাঠে গোল করার মতো ব্যাপার। সেই একটি আসন কোনটি জানতে চাওয়া মাত্র বিজেপি নেতারা স্বর নামিয়ে বলবেন, ভুলে যাবেন না, মাধবসিন সোলাঙ্কি এখনো বেঁচে আছেন।

মাধবসিন সোলাঙ্কি গুজরাটের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেস পার্টিটা একটা সময় তাঁর কাঁধেই ভর দিয়ে চলেছে। ক্ষত্রিয়, হরিজন, আদিবাসী ও মুসলমানদের ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে গড়া ‘খাম তত্ত্ব’ তাঁকে এই রাজ্যের রাজনীতিতে অমর করে রেখেছে। অবশ্যই সেটা ছিল কংগ্রেসের স্বর্ণযুগ। আনন্দ জেলা এখনো তাঁর খাসতালুক।

গান্ধীনগরের সামান্য দক্ষিণে আহমেদাবাদ পেরিয়ে আরও এক শ কিলোমিটার মতো গেলেই আনন্দ। এই এলাকা এ দেশের দুধসাগর। পরিচিতি দুধের রাজধানী হিসেবে, ‘আমূল’ যার ‘ব্র্যান্ড নেম’। দুধকে কেন্দ্র করে সমবায় আন্দোলন জনজীবনে কী বিপুল পরিবর্তন আনতে পারে, আমূল না দেখলে তা বোঝা অসম্ভব। আনন্দ লোকসভার বরসাদ বিধানসভা কেন্দ্র ছিল মাধবসিন সোলাঙ্কির নির্ভয় বিচরণভূমি। তাঁর শ্বশুর ঈশ্বর চাওড়া ছিলেন আনন্দ থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসের পাঁচবারের সাংসদ। মাধবসিনের একমাত্র পুত্র ভারতসিন সোলাঙ্কিও গতবার বিজেপির কাছে হারের আগে এই আনন্দ থেকে দুবার জিতেছিলেন। কাজেই, অমিত শাহ যদি আনন্দ আসনটি ছাড় দিয়ে থাকেন, তা হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। ৯২ বছর বয়স হলেও মাধবসিন এখনো অথর্ব নন।

মাধবসিন আজ বহু বছর গান্ধীনগরের বাসিন্দা হলেও ছেলে ভারত আনন্দ চষে বেড়াচ্ছেন। প্রকাশ্যে বলছেন, আনন্দ যদি কংগ্রেস না পায়, তা হলে অন্য কোনো আসন পাওয়ার স্বপ্ন না দেখাই ভালো। ২০১৪-র মোদি-সুনামি সত্ত্বেও ভারতসিন আনন্দে হেরেছিলেন ৬০ হাজারের ব্যবধানে। রাহুল গান্ধীকে বলেছেন, আনন্দ নিয়ে না ভেবে তিনি যেন অন্য কেন্দ্রগুলোর দিকে নজর দেন।

রাহুলের নজর কিন্তু এবার একেবারে শুরু থেকেই গুজরাতে গেঁথে আছে। কীরকম, সেই নমুনা দিয়ে কংগ্রেস নেতা হিমাংশু ব্যাস বলেন, ‘৫৮ বছর পর গুজরাটের গান্ধীনগরে রাহুল কেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক করতে গেলেন বলতে পারেন? স্রেফ এটা বোঝাতে, নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলা তিনি একেবারে মুখোমুখি করতে চান।’ সেই বৈঠকে মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে প্রিয়াঙ্কাও গান্ধীনগরে এসেছিলেন। রাহুল তার পর তিন দফায় গুজরাট ঘুরে প্রচার করলেন। মোদি-শাহ যেখানে বিকাশ ও উন্নয়নকে পাশে সরিয়ে দেশের নিরাপত্তা, সন্ত্রাস, পাকিস্তান বড় করে তুলে ধরছেন, রাহুল সেখানে প্রচারে তুলে ধরছেন জল-জমি-জঙ্গলের কথা। আর দেখাচ্ছেন ন্যায়ের স্বপ্ন।

গুজরাটের শহরগুলোয় গেলে, হাইওয়ে ধরে এগোলে বড় বড় হোর্ডিং চোখে পড়বে। বিজেপির হোর্ডিংয়ে মোদির মুখ ও একটি মাত্র স্লোগান, ‘ফির একবার, মোদি সরকার’। সেই সঙ্গে রয়েছে গুজরাটি গর্ব খর্ব হতে না দেওয়ার অনুরোধ। কংগ্রেসের প্রচারে রাহুল-সর্বস্ব। কোনোটায় দরিদ্র চাষির সঙ্গে, কোনোটায় সাধারণ মানুষের পাশে, কোনোটায় নানা বয়সী মহিলাদের হাতে হাত রেখে, কোনোটায় বা অসুস্থ কিশোরের পাশে দাঁড়ানো রাহুলের হাসিমুখের ছবি। কোনো ছবির ওপরে ২২ লাখ সরকারি শূন্যপদে লোক নেওয়ার অঙ্গীকার, কোনোটায় লেখা সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ মহিলার সংরক্ষণ, কোনোটাতে সরলীকৃত একটাই জিএসটি, কোনো ছবির ওপরে বছরে ৭২ হাজার টাকা গরিবের ব্যাংক খাতায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি হোর্ডিংয়ের তলায় বড় বড় করে লেখা কংগ্রেসের স্লোগান, ‘এবার হবে ন্যায়’।

সেই ন্যায়ের চরিত্র কী রকম এবং কেন এবারের ভোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, একের পর এক জনসভায় রাহুল সেটাই বলে চলেছেন। ন্যূনতম আয় যোজনা, সংক্ষেপে যা ‘ন্যায়’, যার লক্ষ্য সাধারণ দরিদ্র মানুষ, রাহুল সেটাই করে তুলেছেন মূল অস্ত্র। দক্ষিণ গুজরাটের বারদোলি কেন্দ্রের বাজিপুরায় গত শুক্রবার তিনি বললেন, মোদিজির মতো বছরে ২ কোটি চাকরি দেওয়ার স্বপ্ন দেখাব না। কারণ অত চাকরিই নেই। প্রত্যেক মানুষের ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ করে টাকা দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দেব না। কিন্তু আদিবাসী মানুষকে জল-জঙ্গল-জমির অধিকার দেব। গরিব মানুষকে বছরে ৭২ হাজার টাকা দেব। যা পারব, সেই অঙ্গীকারই করব। মিথ্যাচার করব না।

কংগ্রেসের সাবেক মন্ত্রী কপিল সিবালকে গুজরাট এসেছেন। এসেছেন ভূমিপুত্র স্যাম পিত্রোদাও। আহমেদ প্যাটেল ভোটে দাঁড়াননি। ভারুচে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। পাঁচ বছর আগে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার তাঁদের হাতে হাতে। একটার পর একটা প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করে তাঁরা এই কথাটাই প্রমাণ করতে চাইছেন, নরেন্দ্র মোদি ও শূন্য কুম্ভ সমান। দুটোই ফাঁকা। তাই আওয়াজ বেশি।

মোদির গুজরাটি অস্মিতা বনাম রাহুলের ন্যায়। মানুষ কোনটা বাছবে?