ঘরে–বাইরে চাপে মোদি সরকার

পেঁয়াজ নিয়ে বন্ধুদেশের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা। বিজেপি জোটে চিড়। সবচেয়ে পুরোনো শরিকের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ। পূর্ব লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা।

নরেন্দ্র মোদি

ঘরে–বাইরে হঠাৎই চাপে পড়ে গেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এতটাই যে শেষ পর্যন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, বিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। মানুষ যেন বিভ্রান্ত না হয়।

প্রতিবেশী ‘বন্ধুদেশের’ ক্ষোভ প্রশমনের মাধ্যমে সেই চাপ কাটাতে সক্রিয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ রপ্তানির ‘বিরূপ ঝাঁজ’ অন্তত কিছুটা কাটাতে অতিসচেষ্ট। গতকাল শুক্রবার সেই লক্ষ্যে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে বোঝাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তারা সফলও হয়েছেন। রাতে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় বিদ্যমান চুক্তির (এলসি) আওতায় স্থলবন্দরে অপেক্ষমাণ রপ্তানিযোগ্য ট্রাকগুলোকে ছাড় দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। নোটিশ জারির দিন অর্থাৎ ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বন্দরে থাকা পেঁয়াজবাহী ট্রাকগুলো এই ছাড়ের আওতায় পড়বে।

সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করেছে কৃষি সংস্কারের একাধিক সিদ্ধান্ত, যার দরুন শাসক দল বিজেপির সবচেয়ে পুরোনো শরিক অকালি দল কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কৃষিপ্রধান পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয়েছে কৃষক বিক্ষোভ। একই সময়ে দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে রপ্তানি বন্ধের নির্দেশ ক্ষিপ্ত করেছে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকের পেঁয়াজচাষিদের। কৃষক বিক্ষোভ ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলতে হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু তাতেও ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। বরং চাপ বেড়েছে হরিয়ানায় বিজেপির জোটসঙ্গী জননায়ক জনতা পার্টির (জেজেপি) ওপর। এই দলের সমর্থন নিয়ে ওই রাজ্যে সরকার চালাচ্ছে বিজেপি।

ঘরের মাঠে চাপে পড়ার একটি বড় কারণ ছিল পূর্ব লাদাখের উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত পরিস্থিতি। সার্বভৌমত্ব ও দেশের অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকারের কথা শোনালেও সীমান্তে নতুন করে জমি হারানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখনো বিরোধীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সংসদে এ নিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত হতে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রশ্ন ঘিরে, বিরোধীদের তাই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। খোলামেলা সরকারবিরোধিতার রাস্তায় তারা যেতে পারছে না। কিন্তু কৃষি সংস্কার সেই সংযম ধরে রাখতে পারেনি।

করোনাকালে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করেছিল। নিয়ম মেনে এবার সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে সেগুলো আইনে পরিণত করা হচ্ছে। লোকসভায় সে জন্য তিনটি বিল পাস করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধিতায় নেমে গেছে কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলো। বিভিন্ন কৃষক সংগঠন আন্দোলনে নেমে পড়েছে। পাঞ্জাবের কৃষকেরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বিল যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁদের রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সেই বিক্ষোভের মুখেই অকালি দল কেন্দ্রের সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। দলের নেত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরত কৌর মন্ত্রিত্ব ছেড়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একই রকম চাপ সৃষ্টি হয়েছে হরিয়ানার জেজেপি নেতা দুষ্মন্ত চৌটালার ওপর। এই দলের সমর্থনে রাজ্যে টিকে আছে বিজেপির সরকার। দুষ্মন্ত রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী। প্রভাবশালী জাঠ কৃষকেরাই তাঁর প্রধান সমর্থক।

ঘরের এই চাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ করেছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশকে। সবচেয়ে বড় কথা, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত চরম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।

ঘরের এই চাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ করেছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশকে। সবচেয়ে বড় কথা, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত চরম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আচমকা এ সিদ্ধান্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এতটাই অখুশি যে কেউ কেউ এ সিদ্ধান্তকে ‘নাশকতাতুল্য’ বলে মনে করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিন দিন ধরে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলের’ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গতকালও এই মন্ত্রণালয়ের কর্তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, যাতে বিদ্যমান ‘লেটার অব ক্রেডিটের’ (এলসি) আওতায় বিভিন্ন স্থলবন্দরে আটকে থাকা পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকগুলোকে ছাড় দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তগুলোয় পেঁয়াজবোঝাই আট শতাধিক ট্রাক আটকে রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ সেই ট্রাকগুলোকে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দরুন’ দ্রুত ছেড়ে দিতে সরকার অবশেষে রাজি হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দূতিয়ালির সার্থকতা সেটাই।

বাংলাদেশ সবচেয়ে ‘বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য’ প্রতিবেশী হলেও নানা কারণে সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন চলছে। দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়ের’ কথা বললেও অসন্তোষ ও অশান্তির ফল্গু কেউই অস্বীকার করতে পারছে না। বিভিন্নভাবে তার প্রতিফলনও ঘটে চলেছে। পেঁয়াজ রপ্তানি নিয়ে ভারতের ‘খামখেয়ালিপনা’ তার একটি বড় কারণ।

কৃষকদের অধিকার হরণ নিয়ে বিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। বলছে, নতুন আইন কৃষকদের সর্বনাশ ঘটাবে। মানুষ যেন বিভ্রান্ত না হন।
নরেন্দ্র মোদি, প্রধানমন্ত্রী, ভারত

গত বছরও ভারত আচমকাই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে তা এতটাই বিরক্ত করেছিল যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে এসে প্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, বন্ধুত্বের খাতিরে ভারত যেন তাঁদের আগাম জানায়। এবার বাংলাদেশ যে কড়া প্রতিবাদপত্র ভারতকে দিয়েছে, তাতেও এই আগাম বার্তার প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে লিখে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়াকে এবারও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

বস্তুত, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হতবাক করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চিড় ঠেকাতে যাঁরা সদা সচেষ্ট, সেই মহল এ সিদ্ধান্তকে ‘নাশকতাতুল্য’ বলে মনে করছেন। একান্তে তাঁরা স্বীকার করছেন, ভারতবিরোধী যেসব শক্তি প্রতিবেশী দেশে সক্রিয়, এ সিদ্ধান্ত তাদের উৎফুল্ল করবে। এই মহল কদিন ধরেই তাই চেষ্টা চালাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হলেও যাতে বিভিন্ন স্থলসীমান্তে অপেক্ষমাণ পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকগুলো অন্তত বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি পায়।

পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বিহার নির্বাচনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রুখতেই ওই সিদ্ধান্ত। সেই বিহারের বন্যাপ্রবণ কোশি এলাকায় একটা রেলসেতু প্রকল্প অনুষ্ঠানে গতকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘কৃষকদের অধিকার হরণ নিয়ে বিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। বলছে, নতুন আইন কৃষকদের সর্বনাশ ঘটাবে। মানুষ যেন বিভ্রান্ত না হন।’ স্পষ্টত আচমকাই ঘরে–বাইরে চাপে পড়ে গেছে মোদি সরকার।