দাঙ্গা ভুলে হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ হিন্দু-মুসলমানের

বিতর্কিত কৃষি আইন জাট, গুজ্জর, ত্যাগী, ব্রাহ্মণ ও দলিত কৃষকদের সমর্থন ধরে রাখতে পারবে কি না, শাসক মনে এই মূহূর্তে তা বড় প্রশ্ন।

গাজিপুর সীমান্ত। কৃষক সমাবেশে এক মঞ্চে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের সব ধর্ম উপস্থিতি।
ছবি: সংগৃহীত

শেষ পর্যন্ত কী হবে পরের কথা, আপাতত দেখা যাচ্ছে, কৃষক আন্দোলন পশ্চিম উত্তর প্রদেশের চুরচুর হয়ে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে জোড়া লাগিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান অতীত ভুলে নতুন করে কাঁধে কাঁধ ও হাতে হাত মিলিয়েছে। বছর আটেক আগে সম্প্রীতি বা সৌভ্রাতৃত্বের এই ছবি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

উত্তর প্রদেশ ও দিল্লির সীমান্ত গাজিপুরে সম্প্রীতির হারিয়ে যাওয়া সেই ছবি দৃশ্যমান। একই মঞ্চে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি। মঞ্চের পেছনে ‘হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাহি ভাইচারা’ লেখা ব্যানার। লঙ্গরে পাত পড়ছে ধর্ম ও জাত ভোলা কৃষকদের, এত দিন যাঁরা এই ভাগাভাগিকে চেতনে-অবচেতনে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। আজ ধর্ম, জাত, খাপ বা গোত্র ভুলে সবাই ভারতীয়।

বিভেদের ঝাঁকিদর্শন ও রাজনৈতিক প্রভাব

ভেদাভেদ ও শত্রুতা কী তীব্র আকার ধারণ করেছিল, সেই ঝাঁকিদর্শনে পিছিয়ে যেতে হবে সাড়ে সাতটি বছর। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরের সামান্য এক ঘটনা ছড়িয়ে দিয়েছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দুই মাস ধরে চলা দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে মারা গিয়েছিলেন ৪২ জন মুসলমান ও ২০ জন হিন্দু। গুরুতর আহত হয়েছিলেন ৯৩ জন। দুই সম্প্রদায়ের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিলেন। পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জেলায় জেলায় সৃষ্টি হয়েছিল উৎখাত হিন্দু-মুসলমানদের শিবির। দুই মাস ধরে চলেছিল কারফিউ ও সেনা টহল। দিন দিন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী পরিখা গভীরতর হয়েছে। তীব্রতর হয়েছে পারস্পরিক ঘৃণা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস। পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহও অসম্প্রীতির কালিমা ধুতে পারেনি। বরং হিন্দুত্ববাদের প্রসার বিভেদ আরও বাড়িয়ে তোলে। এই সামাজিক আবহে নতুন বিতর্কিত কৃষি আইন আচমকাই হয়ে উঠেছে সেই জিওনকাঠি, যার ছোঁয়ায় সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ঘৃণার কৃষ্ণপক্ষ দূর হয়ে হেসে উঠছে সম্প্রীতির শুক্লপক্ষ। শঙ্কা, সংশয়, ক্ষোভ ও বিষণ্নতার মাঝে এ যেন এক টুকরো স্বস্তির ঝলক।

শুধু গাজিপুর নয়, কৃষকদের প্রতিটি মঞ্চ ও মহাপঞ্চায়েত থেকে ইদানীং শোনা যাচ্ছে নেতাদের মাভৈ স্বর, ‘এই আন্দোলন হিন্দুস্তানের কৃষকদের। আমাদের পরিচয় শুধু হিন্দুস্তানি। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, ইসাহি নয়। মনে রাখতে হবে, জাত-ধর্ম আমাদের বিভাজনে রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার।’

পূর্ব দিল্লির গাজিপুর সীমান্তেই অবস্থিত দিল্লির সবচেয়ে বড় মাছ-মুরগির মান্ডি। এই পাইকারি বাজার থেকে গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে যায় ফি দিনের প্রয়োজন। সিংঘু ও টিকরির মতো গাজিপুর সীমান্তেও অবরোধ চলছে মান্ডির কাজে বিন্দুমাত্র বাধা সৃষ্টি না করে। এ-ও এক অদ্ভুত ভাইচারা। কোথাও স্থানীয় মানুষ অথবা ব্যাপারীদের অসুবিধা হয়ে ওঠেননি তাঁরা। বরং সমস্যা সুরাহায় কৃষকেরা সদা তৎপর।

গাজিপুরের আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের সবচেয়ে বড় সংগঠন ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন (বিকেইউ)। চরিত্রে অরাজনৈতিক হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংয়ের প্রতি এই সংগঠনের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। ধীরে ধীরে বিকেইউর নেতৃত্ব চলে যায় মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের হাতে। চরিত্রগতভাবে ‘অরাজনৈতিক’ থাকলেও বিকেইউ ক্রমেই বিজেপির দিকে ঢলে পড়ে।

মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার পর তারা খোলাখুলি সমর্থন করেছে বিজেপিকে। বিতর্কিত কৃষি আইন জাট, গুজ্জর, ত্যাগী, ব্রাহ্মণ ও দলিত কৃষকদের সমর্থন ধরে রাখতে পারবে কি না, শাসক মনে এই মুহূর্তে তা বড় প্রশ্ন।

সংগঠনে বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধি

চৌধুরী চরণ সিংয়ের আমলে তো বটেই, মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের সময়েও বিকেইউ ছিল ঠাসবুনোট। হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদাভেদ দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ ছিল পশ্চিম উত্তর প্রদেশের সামাজিক বন্ধন। ধর্মান্তরকরণের আগে দেশের এই অংশের জাট, গুজ্জর ও রাজপুতেরা এক সংস্কৃতিই শুধু নয়, বহু ক্ষেত্রে এক গোত্রভুক্তও ছিলেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা ইসলামে দীক্ষিত হন, এই তল্লাটে তাঁরা ‘মুলে জাট’, ‘মুলে গুজ্জর’ কিংবা ‘মুলে রাজপুত’ বলে পরিচিত। মুসলমানদের মধ্যেও তাই হিন্দুদের মতো পদবিগত মিল বিস্তর। চৌধুরী, রানা, চৌহান বা ত্যাগীর ছড়াছড়ি। সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বিয়েশাদির মিল হওয়ার দরুন এক গোত্রভুক্ত হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এই তল্লাটে হুঁকো ভাগাভাগিও ছিল না। দেশের প্রথম মুসলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন এই মুজফ্ফরনগর কেন্দ্র থেকেই। দাঙ্গায় সব ওলট-পালট হয়ে যায়।

# ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট পশ্চিম উত্তর প্রদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, চলে দুই মাস পর্যন্ত।
# ওই দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে মারা গিয়েছিলেন ৪২ জন মুসলমান ও ২০ জন হিন্দু।
# আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে ধর্ম, জাত, গোত্র ভুলে সবাই এখন এক কাতারে।

কৃষক আন্দোলন সেই লুপ্ত সৌভ্রাতৃত্ববোধ পুরোপুরি ফিরিয়ে এনেছে, এখনই জোর দিয়ে বলা যাবে না। কিন্তু যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছিল, জল-চল-সামাজিকতা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল, ক্রমেই তা ফিরে আসছে। আন্দোলন দুই পক্ষকে পাশাপাশি টেনেছে। দুই হাত এক করেছে।

চরণ সিংয়ের জীবদ্দশায় পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কৃষককুল অবাধ্য হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র অজিত সিংও কিছুদিন সেই প্রভাব টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বারবার দলবদল ও জোটবদল তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের মৃত্যু এবং দল হিসেবে বিজেপির উত্থান বিকেইউর ওপর যে প্রভাব ফেলে, তাঁর দুই পুত্র রাকেশ ও নরেশও তার সামাল দিতে পারেননি। দাঙ্গার পর টিকায়েতরা খোলাখুলি বিজেপির সমর্থক হয়ে পড়েন। ধর্মীয় মেরুকরণ ভেঙে দেয় বিকেইউর অরাজনৈতিক চরিত্রও। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা এবং ২০১৭ বিধানসভা ভোটে জয়জয়কার হয় বিজেপির।

রাকেশ টিকায়েতের কান্না ও মহাপঞ্চায়েত

২৬ জানুয়ারির লালকেল্লা অভিযান ছিল কৃষক আন্দোলনের এক ভিন্ন অধ্যায়। নেতাদের দুর্বলতা হোক অথবা শাসকের চক্রান্ত, ওই ঘটনা আন্দোলনে মারাত্মক ধাক্কা দিয়ে যায়। তার অভিঘাতে গাজিপুর সীমান্ত থেকে হতোদ্যম কৃষকেরা ফিরে যেতে থাকেন। গাজিপুর অবরোধের মধ্যমণি মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের পুত্র রাকেশ ২৮ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলেন। তাঁর কান্নার ছবি ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে যায়। নেতার অশ্রুতে বিচলিত কৃষকেরা ফিরে আসতে থাকেন অবরোধস্থলে। রাকেশের কান্না জাট জাত্যভিমানে এত প্রবল ধাক্কা দেয় যে ২৯ জানুয়ারি মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েতের আসরে সটান হাজির হন বিকেইউর একসময়ের মুসলমান জাট নেতা গোলাম মহম্মদ জাউলা। রাকেশের ভাই নরেশের পাশে দাঁড়িয়ে সেই মহাপঞ্চায়েত থেকে গোলাম মহম্মদ বলেন, ‘এখন অতীত আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না। গোটা কৃষকসমাজ আজ সংকটের মুখোমুখি। এখন এক হওয়ার সময়। জোটবদ্ধ হয়ে এই লড়াই জিততে হবে। আমরা সবাই কৃষক। সেটাই আমাদের একমাত্র পরিচয়। ধর্ম বা জাত নয়।’

‘মুলে জাট’ গোলাম মহম্মদ জাউলা ছিলেন মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও সমগোত্রীয়। তাঁর আহ্বান সম্প্রীতির বার্তা জোরদার করে তোলে। একের পর এক মঞ্চ ও মহাপঞ্চায়েত থেকে উচ্চারিত হতে থাকে সম্প্রীতি রক্ষার বার্তা। শাসকের কাছে ক্রমেই তা হয়ে উঠছে অশনি সংকেত। অযোধ্যা আন্দোলন ধর্মীয় মেরুকরণের যে অনুকূল আবহ সৃষ্টি করেছিল, কৃষক ঐক্য হয়ে উঠতে পারে তার প্রতিষেধক। উদ্বিগ্ন উত্তর ভারতের বিজেপির রাজ্যস্তরীয় নেতারা দরবার শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদিও এখনো অনড়।

শাসক দল বিজেপির প্রতীক।
ছবি: সংগৃহীত

বিজেপির অঙ্ক ও সম্প্রীতি

কৃষি আইন প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রী মোদি রাজি নন একাধিক কারণে। প্রথমত, লোকসভা ভোটের পুরো চার বছর বাকি। দ্বিতীয়ত, দলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আধিপত্য প্রশ্নাতীত। তৃতীয়ত, কৃষক আন্দোলন সর্বত্র তেমন জোরদার নয়। চতুর্থত, চলতি বছরে যে পাঁচ রাজ্য বিধানসভার ভোট, সেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা ও পদুচেরিতে কৃষি আইন এখনো প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠেনি।

আন্দোলন তীব্র যে দুই রাজ্যে, সেই পাঞ্জাবে লোকসভার আসন ১৩, হরিয়ানায় ১০। মোদি কিঞ্চিৎ চিন্তিত হরিয়ানার জোট সরকার ধরে রাখার ব্যাপারে এবং কিছুটা পশ্চিম উত্তর প্রদেশ নিয়ে। উত্তর প্রদেশের ৭৫ জেলার মধ্যে এই তল্লাটে রয়েছে ২৯টি। ৮০ লোকসভা আসনের মধ্যে এই অংশে পড়ছে ২৯টি। ৪০০ বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৪৫টি। মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার পর এই অঞ্চলে সব ভোটে বিজেপি দাপট দেখিয়েছে। কৃষক আন্দোলন তা কতটা কমাতে পারে, আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনে সেটাই মুখ্য প্রশ্ন। কিন্তু সেই ভোট আসতেও এক বছর দেরি। এই সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

যেমন প্রথমত, এই তল্লাটের কৃষকেরা এখনো পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের ব্যক্তিগত সমালোচনা করেননি। রাজনৈতিক সমীকরণকে তাঁরা এখনো গুরুত্ব দেননি। দ্বিতীয়ত, টিকায়েতদের মন জিততে বিজেপির চেষ্টার অন্ত নেই। তৃতীয়ত, কৃষক আন্দোলনে পুনরুজ্জীবিত অজিত সিং ও তাঁর পুত্র জয়ন্ত চৌধুরীর রাষ্ট্রীয় লোক দলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক অহি-নকুলের নয়। ভোটের আগে তাঁরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামতেও পারেন। সেই তাগিদও যথেষ্ট, কারণ, গত লোকসভা ভোটে পিতা-পুত্র দুজনকেই বিজেপির কাছে হারতে হয়েছিল। চতুর্থত, উত্তর ভারতের বিজেপি নেতাদের প্রবল চাপে প্রধানমন্ত্রী যে শেষ পর্যন্ত আইন নিয়ে ভিন্ন ভাবনার শরিক হবেন না, এখনই জোর দিয়ে বলা যায় না। পঞ্চমত, আইন বদল না করেও ভোটের আগে বিজেপি কৃষক মন জিততে অন্য ছক কষতে পারে, যা জাতপাতভিত্তিক সমীকরণকে সামনে টেনে আনার যোগ্য। সবার শেষে রয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণের জন্য ‘লাভ জেহাদের’ মতো অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার!

পরের কথা তাই পরে। আপাতত স্বস্তি দিচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির সোনালি ঝিলিক, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের কৃষক ঐক্যকে যা জোরদার করেছে।