দার্জিলিং আবার অশান্ত হচ্ছে?

দার্জিলিংয়ের অপরূপ প্রকৃতি হাতছানি দেয় হাজারো পর্যটককেছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন এলেই কয়েকটি রাজনৈতিক ইস্যু উঠে আসে রাজনৈতিক অঙ্গনে, প্রতিবারই। শাসক দলকে ঘায়েল করতে এবং ভোটযুদ্ধে বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরেই এই ইস্যু গুলি তুলে আসছে। অতীতে দেখা গেছে মাওবাদী, দার্জিলিং ইস্যু বারবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করেছে। এখনকার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা গড়া এবং নন্দীগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণ করে সেখানে রসায়ন শিল্প কারখানা গড়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মাত করে মাঠ। এই দুই সফল আন্দোলন পরে নির্বাচনী ইস্যু হয়। বামফ্রন্টকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল।

আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে এবং সারদা-রোজভ্যালি-নারদ কাণ্ড ও জঙ্গলমহল- দার্জিলিং ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজ্য। এবার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে দার্জিলিং ইস্যুকে ঘিরে।

দার্জিলিংয়ের প্রকৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ চায়ের বাগান
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পার্বত্য জেলা দার্জিলিংকে ভেঙে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছিল। তবে দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। এই আন্দোলনের মূল শক্তি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে ভেঙে দিয়ে জনমুক্তি মোর্চার বহু নেতাকে নিজেদের দলে ভেড়ায় শাসক দল তৃণমূল। জনমুক্তি মোর্চার নেতা ও দলের সভাপতি বিমল গুরুং এই আন্দোলন বেগবান করে তুলেছিলেন। সেই বিমল গুরুং এখন আত্মগোপন করে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঝুলছে হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা অভিযোগে মামলা। দার্জিলিংয়ে বিমল গুরুংয়ের আগে এই আন্দোলন তীব্রভাবে গড়ে তুলেছিল জিএনএলএফ বা গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট। এর নেতা ছিলেন প্রয়াত সুভাষ ঘিসিং।

দার্জিলিংয়ে রয়েছে বিধানসভার ৬টি আসন এবং লোকসভার একটি আসন। লোকসভার আসনটি গত ১১ বছর ধরে বিজেপির হাতে। গত বছর এই আসনের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্ত জয়লাভ করেন। বিধানসভার ৬ আসনের মধ্যে জনমুক্তি মোর্চা ৩টি, কংগ্রেস ২টি এবং সিপিএম একটি আসনে জয়ী হয়েছিল।

গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার জন্য ব্রতী হবেন। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি পৃথক রাজ্য গড়ার দাবিতে কোনো ভূমিকা নেননি। বরং করোনার কোপে এসব আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

দার্জিলিং শহর
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

এবার রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এগিয়ে আসলে সোচ্চার হয় বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্ত। ভোটে দার্জিলিংয়ের ভোট করায়ত্ত করার জন্য ঝালাই দেন গোর্খাল্যান্ড ইস্যুকে। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে দাবিও তোলেন দার্জিলিংয়ে পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড গড়ার। যদিও এই রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলই দার্জিলিং ভেঙে পৃথক গোর্খাল্যান্ড গড়ার বিরুদ্ধে। অন্যদিকে গোর্খাল্যান্ড গড়ার মূল আন্দোলনকারী জনমুক্তি মোর্চার কোমর ভেঙে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । জনমুক্তি মোর্চার মূল সংগঠনের সভাপতি বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এসবের মাঝে স্থানীয় সাংসদ রাজু বিস্তর পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি তোলায় ক্ষেপে গেছে ‘আমরা বাঙালি সংগঠন।’

আমরা বাঙালির কেন্দ্রীয় সচিব বকুল চন্দ্র রায় সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গকে খণ্ডিত করার চক্রান্তে ফের মেতে উঠেছে দার্জিলিংয়ের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্ত। এই চক্রান্ত প্রতিরোধ করবে আমরা বাঙালি। কোনোক্রমেই ‘আমরা বাঙালি’ মেনে নেবেনা দার্জিলিংকে দ্বিখণ্ডিত করার চক্রান্তকে। এর বিরুদ্ধে মাঠে নেমে আমরা বাঙালি শিলিগুড়ি, হাওড়া এবং বারাসাতে প্রতিবাদ সভা করে রাজু বিস্তর কুশপুতুল দাহ করেছে।’

পার্বত্য এই অঞ্চলকে অশান্ত করে তোলার মূল উদ্দেশ্য সামনের নির্বাচন, স্থানীয় বাঙালিদের ধারণা এমনই। তবে এতে করে স্থানীয়দের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।

বকুল চন্দ্র রায় আরও বলেছেন, ’বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং চীন সীমান্ত ঘেঁষা আমাদের দার্জিলিং। যা ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এখন এই নেপাল ও চীন সীমান্তে অস্থিরতা চলছে। এর অগে আমরা বাঙালির তরফ থেকে গত জুলাই মাসে কলকাতার নেপাল কনস্যুলেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখাই। সেদিন ‘আমরা বাঙালির’ ১২ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল’।

পার্বত্য এই অঞ্চলকে অশান্ত করে তোলার মূল উদ্দেশ্য সামনের নির্বাচন, স্থানীয় বাঙালিদের ধারণা এমনই। তবে এতে করে স্থানীয়দের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এতে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের বিশাল পর্যটন শিল্পের। করোনার কারণে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে সবল করার প্রচেষ্টা এতে ব্যাহত হবে বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা।