দিদিকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার নয়: আব্বাস সিদ্দিকী

কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে গতকাল রোববারের সমাবেশে বক্তব্য দেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে গতকাল রোববার এক বিরাট জনসভার আয়োজন করেছিল কংগ্রেস ও বামপন্থী দলগুলো। তাদের সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হঠাৎই সামনের সারিতে চলে আসা মুসলমান সমাজের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। কিছুদিন আগেও আব্বাস সিদ্দিকী বামপন্থীদের-বিরোধী ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে আসনরফা নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। সেখান থেকে রাতারাতি সমঝোতা করে ফেললেন বামপন্থীদের সঙ্গে, যাদের থেকে দশ বছর আগে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিচারপতি সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলমান সমাজের অনুন্নয়নের প্রশ্নটিকে তুলে ধরা হয়েছিল। মূলত সে কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন মুসলমানরা।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের মুখোমুখি হয়ে আব্বাস সিদ্দিকী জানান, কেন তিনি বাম ফ্রন্টের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আব্বাস বলেন, ‘একটা বৃহৎ শক্তি দেশটাকে লুট করছে। সেই শক্তিকে রুখতে ও দেশকে বাঁচাতে…যে আমার ক্ষতি করেছে, তাকেও  কিছুক্ষণের জন্য সঙ্গে নিয়ে চলা প্রয়োজন।’

আব্বাস সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) নামে নতুন দল ঘোষণা করেছেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে তাঁর দলকে ২৯৪-এর মধ্যে অন্তত ৩০টি আসন ছাড়তে পারে বাম–কংগ্রেসের জোট সংযুক্ত মোর্চা।

তা যদি হয়, তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, বাম-কংগ্রেসের সমর্থনে কিছু ভোট পাবে আইএসএফ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমান। দক্ষিণবঙ্গে মুসলমান ভোটের বড় অংশটিই পায় তৃণমূল কংগ্রেস। এই ভোটের কয়েক শতাংশও তৃণমূলকে ছেড়ে গেলে তাতে লাভ হবে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। মুসলিম ভোট বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু তা যদি তৃণমূল থেকে বেরিয়ে আইএসএফে যায়, তবে বিপদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সম্ভবত সে কারণেই হাওড়া জেলার এক সভায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমার যদি নির্বাচনে লড়ার অধিকার থাকে, তবে আব্বাস সিদ্দিকীরও রয়েছে।’

বিজেপি ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে ২০১৭-র নির্বাচনে ৪০৩টি আসনের একটিতেও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। উত্তর প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ। লোকসভাতে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বিজেপির কোনো মুসলিম সাংসদ ছিলেন না—১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে ভারতের যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের জন্য যা একটা রেকর্ড। অনেক রাজ্যেই মুসলিম প্রার্থী না দিয়েও এখন নির্বাচনে জিতছে বিজেপি।

সেই বিজেপি কি তাঁর সম্পর্কে একটা নরম মনোভাব নিচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তরে আব্বাস সিদ্দিকী বলেন, ‘এটা বিজেপির একটা ষড়যন্ত্র। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ আমার কাছে আসছেন, তাই বিজেপি এমনভাবে বার্তা দিচ্ছে, যাতে মনে হয় বিজেপির সঙ্গে আমার ভেতরে–ভেতরে কোনো বোঝাপড়া রয়েছে। ওরা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ও সংবিধানকে আঘাত করেছে। ফলে বিজেপিকে রুখতে একটা মহাজোটের দরকার আছে। মহাজোট না করে চারজন আলাদা প্রার্থী দিলে ভোট ভাঙবে, তাতে লাভ বিজেপির। আমি বলেছিলাম তৃণমূল, বামপন্থীরা, কংগ্রেস—সবাই এক হোন, কিন্তু সেটা হলো না।’

ব্রিগেডের সমাবেশে বাম ও কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকী
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

মাসখানেক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন মুসলিম সমাজের এই জনপ্রিয় নেতা। তিনি ব্যাখ্যা করলেন কেন কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মমতাবিরোধী হয়ে পড়লেন। আব্বাসের বক্তব্য, ‘দিদিমণিকে যখন বলেছিলাম, তখন আমার দাবি ছিল ৪৪টি আসনে প্রার্থী দেব আর বাকি ২৫০ আসনে প্রচারে যাব। কিন্তু যেটা দেখলাম সেটা হলো যে তৃণমূল কংগ্রেস সে–ই আসলে বিজেপি। তারা বিজেপিকেই আনতে চাইছে। সে কারণেই এই জোটের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

দিদিকে বিপদে ফেলার কোনো শখই আমার নেই, কিন্তু বাঁচানোর দায়িত্বও আমার নয়।’
আব্বাস আরও বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস সাচার কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করবে বলেছিল, করেনি। বরং একটা হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরি করেছে। তোষণের নামে বিষ ছড়িয়েছে। ইমামদের ভাতা দেওয়ার মতো বিষয় দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেছে।’

আব্বাসের পরিবারের অপর একটি অংশ রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। এই অংশটির মাথায় রয়েছেন পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী, আব্বাসের কাকা। ভাইপোর কার্যকলাপ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য না করলেও এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ মমতাকেই ভোট দেবেন বলে ত্বহা সিদ্দিকী মনে করেন। আব্বাস অবশ্য মনে করেন, মমতার ‘মুসলমান ফর্মুলা’ আর কাজ করবে না।

আব্বাস সিদ্দিকী বললেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মূল বিরোধী শক্তি ছিল বামেরা। তাদের মেরে, বাড়িঘর পুড়িয়ে বিজেপির জন্য জায়গাটা বানাল কে? এটাই চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়—৩০ শতাংশ মুসলমান ভোট তাঁর দিকে থাকবে, বিজেপির ভয় দেখিয়ে মুসলমান ভোটটাকে বরাবর নিজের দিকে রাখবেন। আর পাশাপাশি কোনোভাবে ১০-১৫ শতাংশ হিন্দু ভোট টেনে ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু দিদি ভাবতে পারেননি যে হঠাৎ করে মহান স্রষ্টা আমায় ময়দানে নামিয়ে দেবেন।’

তবে আইএসএফ নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও তিনি নিজে ভোটে দাঁড়াবেন না বলে জানালেন আব্বাস সিদ্দিকী। তাঁর কথা, ‘বরং আমি কিংমেকার হতে চাই।’