দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়নে বিজেপি যেভাবে বিজয়ী

ভোটের সমীকরণে বিজেপি প্রার্থীই জিতবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিজেপির জন্য দ্রৌপদী মুর্মু নিজস্ব একজন রাষ্ট্রপতির চেয়ে বেশি কিছু হবেন।

দ্রৌপদী মুর্মু
ছবি: এএনআই

ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে আগামী ১৮ জুলাই। বিজেপি জোট তাতে প্রার্থী হিসেবে দিয়েছে দ্রৌপদী মুর্মু নামের এক সাঁওতাল নারীকে। এই মনোনয়ন বেশ চমক সৃষ্টি করেছে। বিরোধী কংগ্রেস জোট মনোনয়ন দিয়েছে যশবন্ত সিনহাকে। সেটাও চমক দিয়েছে। কারণ, যশবন্ত ২০১৮ সালের আগে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তাঁর পুত্র জয়ন্ত সিনহা এখনো বিজেপির লোকসভা সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বেশ ঘনিষ্ঠ।

ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফয়সালা হয় লোকসভা ও রাজ্যসভার এমপি-এমএলএদের বিশেষ পদ্ধতির ভোটে। এবার এ রকম ভোটার-এমপি আছেন ৭৭৬ জন, প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে এমএলএ আছেন ৪ হাজার ১২৩ জন। ভোটের যে সমীকরণ, তাতে বিজেপি প্রার্থীই জিতবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিজেপির জন্য দ্রৌপদী মুর্মু নিজস্ব একজন রাষ্ট্রপতির চেয়ে বেশি কিছু হবেন।

একজন সাঁওতাল নারীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) পরিবার যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে, এই স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। এর আগেও ভারতে নারী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন প্রতিভা পাতিল। কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই প্রথম। উচ্চবর্ণ এবং উচ্চশ্রেণির স্বার্থ দেখেশুনে রাখার পাশাপাশি সমাজের নিচুতলার মানুষদেরও বিচিত্র উপায়ে খুশি রাখতে পারছে বিজেপি। যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য এটা গৌরব করার মতো দক্ষতার দিক।

আরও পড়ুন
দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করায় আনন্দ করছেন ওডিশার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা
এএনআই

আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের জনসংযোগে বিজেপির এই মনোনয়ন অনেক রাজ্যে এগিয়ে রাখবে তাদের। তবে পাশাপাশি এ প্রশ্নও উঠছে, দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সমাজ ঠিক কী পাবে? দ্রৌপদী মুর্মু কি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতীক? নাকি, এই মনোনয়নের বাড়তি কোনো রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে?

দ্রৌপদী যাঁদের সাহসী করে তুলবেন

‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’ কারা এবং তাদের সংখ্যা কত, এ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে কাজিয়া আছে। কোনো কোনো দেশ তাদের জমিনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের উপস্থিতিই অস্বীকার করতে চায়। আবার কিছু দেশে চালু ‘ট্রাইবাল’ শব্দ, যে ‘ট্রাইবাল’দের উৎপত্তি ও নৃতাত্ত্বিক ধরনে বৈচিত্র্য আছে। তবে যে নামেই ডাকা হোক, এ রকম জনগোষ্ঠী আছে এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশে।

১৩০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে প্রায় ৯ ভাগ মানুষ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। বাংলাদেশে তাদের হিস্যা পুরো জনসংখ্যার এক শতাংশের মতো। ভারতে কিছু কিছু রাজ্য আছে, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা ট্রাইবালরাই সংখ্যাগুরু। বাংলাদেশেও সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো ও রকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়নি। নেপালে এ রকম জাতিসত্তার মানুষদের ‘আদিবাসী জনজাতি’ বলা হয়। সেখানে পুরো জনসংখ্যায় জনজাতির হিস্যা বেশ বড়—৩০ থেকে ৩৫ ভাগ হবে। পাকিস্তানে সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং চিত্রলের যথাক্রমে হারি, বাট্টা মজদুর, কাফির বা কালাসদের মতো মানুষদেরও এ রকম ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাতারে রাখা যায়।

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’ বা ‘ট্রাইবাল’দের এই ‘থাকা’ অনেকটা ‘না থাকা’র মতো। কারণ, তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতিতে সমস্যা আছে, পুরোনো বসতিতে তাদের সংখ্যালঘু করে তোলা হচ্ছে, তাদের অধিকারচেতনাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলে দমনের রেওয়াজ আছে, পাশাপাশি তাদের এলাকার মাটির নিচের খনিজ এবং মাটির ওপরের প্রাকৃতিক সম্পদে করপোরেটদের থাবা বাড়ছে।

এ রকম বহু জনগোষ্ঠীর একটি ‘সাঁওতাল’। বাংলায় জমিদার, সুদখোর মহাজন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ১৮৫৫ সালের সশস্ত্র ‘হুল’ বিদ্রোহের জন্য সাঁওতালরা ইতিহাস বইয়ে বিশেষভাবে সুপরিচিত। ভারতের সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এই গোষ্ঠীরই একজন। এটা এক চমৎকার যোগসূত্র যে হুল বিদ্রোহের সূচনা ঘটে ১৮৫৫ সালের জুনে। একইভাবে বিজেপি রাষ্ট্রপতি পদে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ঘোষণা করল ১৬৭ বছর পর আরেক জুনে।

তবে বিজেপি যখন দ্রৌপদী মুর্মুকে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের রাষ্ট্রপতি করতে চলেছে, তখনো সাঁওতালরা ওই দেশের পিছিয়ে পড়া অন্যতম জনগোষ্ঠীই থাকছে। তারপরও মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়া পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সাহসী করবে। হয়তো তারা এখন থেকে বঞ্চিত জীবনের কথা আরও খোলামেলা বলতে উৎসাহিত হবে।

দ্রৌপদী মুর্মুদের জনপদেই মাওবাদের বিস্তার

দ্রৌপদী মুর্মুর বাড়ি ওডিশায়। তবে সাঁওতালরা আছে আরও বহু জায়গায়। আছে বাংলাদেশের রাজশাহী-রংপুরেও। ঝাড়খন্ডে তারা বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ছত্তিশগড়েও তারা আছে। দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়ায় বাংলাদেশের সাঁওতালরাও খুশি। এটা স্বাভাবিক। তবে মুর্মুর সফলতা উদ্‌যাপনের সময় তাদের ভেতর প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ সাঁওতালদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কত দূর এগোল? সেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান আমলে রাজশাহীর সাগরাম মাঝি প্রাদেশিক পরিষদে জিতলেন, তারপর আর কিছু আছে? উত্তর উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ভূসম্পদ যত খুইয়েছে, রাজনীতিতেও তারা তত অদৃশ্য হয়েছে।

যে কেউ আলাপ করলেই বুঝবেন, সাঁওতালদের ‘গল্প’মাত্রই ভূমিহীনতার আহাজারি। সেটা রাজশাহীর গোদাগাড়ি হোক কিংবা রংপুরের মিঠাপুকুর হোক। বিভিন্ন গবেষণার ফল গড় করলে দেখা যায়, ২৫ থেকে ৪০ ভাগ সাঁওতাল ভূমিহীন। এরা কৃষিজীবী মানুষ হলেও জমি ধরে রাখতে পারেনি। বাকিদেরও একই সমস্যা হচ্ছে।

এর মধ্যেই রাজশাহীর অনতিদূরের ঝাড়খন্ডে সাঁওতালরা রাজ্যশাসনের সুযোগ পেল। বিহার ভেঙে ঝাড়খন্ড বানিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে এক দফা খুশি করার চেষ্টা হয়। তাতে সেখানকার মেঠো রাজনৈতিক অর্থনীতি সামান্যই পাল্টায়। তবে এটুকু হয়েছে, সাঁওতাল হেমন্ত সরেন-শিবু সরেনরা ‘শাসক’ হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হতে চলা দ্রৌপদী মুর্মুর ঝাড়খন্ডেই গভর্নর ছিলেন কিছুকাল।

তিনি ওডিশার ময়ূরভঞ্জ জেলার বৈদাপোসি গ্রামের বাসিন্দা। ঝাড়খন্ড থেকে ময়ূরভঞ্জ কিংবা গোদাগাড়ি থেকে মিঠাপুকুর—সর্বত্র তীব্র দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর প্রান্তিকতার মাঝেই সাঁওতালদের বাস। প্রায় সব জনপদে ‘মূল ধারা’র মানুষের চেয়ে সাঁওতালরা আলাদাভাবে দরিদ্র। ওডিশায় সাঁওতালদের তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিত ‘ট্রাইব’ বলা হয়। অথচ সেখানেও সবার সাক্ষরতার গড় ৭৫ শতাংশ, সাঁওতালদের ৩১ শতাংশ।

এ রকম দারিদ্র্যের ভেতর থেকেই বিহার, ওডিশায় মাওবাদী রাজনীতির জন্ম। সশস্ত্রতা রাষ্ট্র সহ্য করতে পারে না। তাই সেই রাজনীতি নির্মূলের চেষ্টা ছিল। কিন্তু বঞ্চনা যত দিন থাকে, লড়াইও হয়তো তত দিন মরে না। ফলে ভারতের মাওবাদী সমস্যা আজও যায়নি। বরং জঙ্গল ছেড়ে এই সমস্যার নগরায়ণ ঘটছে। ২০১৮ সালের আগস্টে ‘আরবান নকশাল’ অভিযোগে অনেক ভারতীয় কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপককে গ্রেপ্তার হতে দেখা গেছে। মূলত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এলাকায় অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা বলেই এরা ‘অপরাধী’। প্রশ্ন উঠেছে, এ রকম ‘অপরাধ’ মোকাবিলার অংশ হিসেবেই দ্রৌপদী মুর্মু চমক হয়ে এলেন কি না!

বিজেপির চাওয়া এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন

ভারতে এখন ‘নকশাল’ মানে সাধারণভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মাওবাদী) অনুসারীরা। ‘নকশাল’ কিংবা ‘আরবান নকশাল’ সবার তীব্র নজরদারিতে থাকেন। এতে কংগ্রেস ও বিজেপির রাজত্বে কোনো ফারাক নেই। জাতীয় রাজনীতির এই উভয় ঘরানা নকশালদের ‘ভারতের একক বৃহত্তম নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ’ মনে করে।

মনমোহন সিংয়ের আমলে এভাবে রণকৌশল তৈরি হয় ‘নকশাল’দের লক্ষ্য করে। বিজেপি সেই নীতি ছাড়েনি। তবে দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়ন ইঙ্গিত দিচ্ছে, নকশালদের মোকাবিলার কৌশল বদলাচ্ছে। হয়তো ‘নকশাল বেল্টের’ রাজনীতিও এখন থেকে নতুন চেহারা নেবে।

ভারতের প্রচারমাধ্যমে যাকে ‘নকশাল বেল্ট’ বলা হয়, ‘কাউন্টার টেররিস্ট এক্সপার্ট’দের কাছে তার আরেক নাম ‘রেড করিডর’। ওডিশা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানার খানিকটাজুড়ে প্রায় ১০০ জেলার সবুজ এক পরিসর এটা। আশপাশের আরও কিছু এলাকাকে যুক্ত করে একে ‘দণ্ডকারণ্য’ও বলা হয়। একসময় যেখানকার বনজঙ্গলে পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া অনেক শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল।

তাদের পাশাপাশি এই এলাকার জনবিন্যাসে আগে থেকেই বিপুল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছে। আর আছে ব্যাপক দারিদ্র্য। আছে খনিজসম্পদও। বন, খনি, কৃষি নিয়ে এখানকার অর্থনীতি। তবে খনিজ উত্তোলনে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের নিয়ম নেই! খনিজ তুলতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল।

ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতার ভোটভিত্তিক পালাবদলে দণ্ডকারণ্য এলাকার ভূমিকা মুখ্য নয়। কিন্তু কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনদের আর্থিক জ্বালানির জন্য মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের যে করপোরেটদের দরকার, তাদের কাছে রেড করিডর বিশেষ দরকারি। যেমন ওডিশা ভারতের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রবণ রাজ্য।

কিন্তু এখানে আছে পুরো দেশের বক্সাইটের ৬০ ভাগ এবং নিকেলের ৯০ ভাগ। তার উত্তরের ঝাড়খন্ড এবং বিহারের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এলাকাগুলোয়ও আছে নানান রকম খনি। এসব অঞ্চল থেকে আবার নেপাল বেশি দূরে নয়। সেখানে বাম রাজনীতি বেশ সবল। এতে ভারতীয় এই পূর্বাঞ্চলে বিপদের গন্ধ আছে। সুতরাং এই ‘করিডর’কে লাল বিপদ থেকে রক্ষা করা বিজেপির করপোরেট বন্ধুদের খুব দরকার। আবার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী দেশের ‘এক নম্বর শত্রু’ জ্ঞান করে বহুকাল দমনাভিযান চালিয়েও নকশালদের পুরোপুরি উৎখাত করতে পারেনি।

‘এলিট ফোর্স’ মাওবাদী ‘মুক্তাঞ্চলে’ বিমানশক্তিও প্রয়োগ করেছে একদা। এ রকম সব অভিযানেরও প্রধানতম ক্ষতির শিকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পাড়াগুলো। অনেকেই তারা এখন উদ্বাস্তু। শিল্পের জন্য জমি ছেড়ে দিতে গিয়েও অনেক বনবাসী উৎখাত হয়। তাতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের বোবা ক্ষোভÿবারবার কেবল বাড়ে। এসব মানুষের কাছে নকশাল আদর্শের আবেদন দুর্বল করতে বিভিন্ন সংস্থা নতুন কৌশল খুঁজছিল অনেক দিন। বিজেপির চাওয়া এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন এভাবেই এক জায়গায় মিলেছে দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়নে।

কংগ্রেস ও বামপন্থীরাও বিস্ময়ের নজির রাখলেন

নকশালরা ভোটের রাজনীতিতে নেই। তারপরও রেড করিডরের রাজ্যগুলোয় বিজেপির অগ্রযাত্রা থমকে আছে। তেলেঙ্গানা, ওডিশা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছে আঞ্চলিক দলগুলো। বিহারেও বিজেপি একচেটিয়া নয়। স্থানীয় জনতা দল তার গায়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে। এই ছয় রাজ্যে লোকসভার আসন ১৪৫। তার ভেতর বিজেপির দখলে মাত্র ৬০টি। মোদি সুনামির মধ্যেও এই ফলাফল মেনে নেওয়া আরএসএসের জন্য সুখকর নয়।

এসব এলাকার আঞ্চলিক দলগুলো এত দিন যে নৈতিক শক্তির জোরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়েছে, তার একাংশ ছিল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীপ্রেম। বিজেপি এবার সেখানে রীতিমতো টর্পেডো ছুড়ল। এই রণকৌশলে ‘রাষ্ট্রের’ স্বার্থও আছে বেশ। আঞ্চলিক দলগুলোকে দিয়ে নকশাল দমনে সুবিধা হচ্ছে না রাষ্ট্রের।

সেই শূন্যতা পূরণ করে রেড করিডরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে দ্রৌপদী মুর্মুর প্রেসিডেন্ট হওয়া ভালো সহায়তা দেবে ভারত ও বিজেপিকে। তার লক্ষণ ইতিমধ্যে স্পষ্ট। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রধান আঞ্চলিক দলগুলো ইতিমধ্যে একে একে যশবন্ত সিনহার বদলে মুর্মুকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে ১৮ জুলাইয়ের ভোটে। অথচ এসব দল রাজ্য রাজনীতির সমীকরণে বিজেপি বিরোধী।

কিন্তু নিজেদের জনভিত্তি ধরে রাখতে তাদের এখন বিজেপির কৌশলের কাছে মাথা নোয়াতে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মুর্মুর বিরুদ্ধে ভোট দিলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এলাকায় এসব দল মুখ দেখাতে পারবে না। শিগগিরই মুর্মুর মনোনয়নকে ব্যাপক প্রচারে এনে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা নকশালপ্রধান এলাকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে এ–ও বোঝাতে চাইবে যে বন্দুক ছাড়াই তারা ভারত রাষ্ট্রের হর্তাকর্তা হতে পারে। নকশাল ‘কমরেড’ হওয়ার দরকার নেই।

সব মিলে, মুর্মুকে দিয়ে আরএসএস চিন্তকরা এক ঢিলে অনেক পাখি শিকার করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। তাঁদের প্রথম শিকার অবশ্যই কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। নিজেদের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের বিপরীত মেরুর মানুষ একজন প্রাক্তন বিজেপি নেতাকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং বাম শিবির বড় ধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নজির রাখল এবার। প্রায় আট বছর নানা ধরনের নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা ক্রমাগত বিজেপির কাছে ভোটে হারছে। এবার তারা নৈতিকভাবেও মোটাদাগে পরাজয়ের মুখে পড়েছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক