পশ্চিমবঙ্গে আবারও মুখোমুখি মমতা-ধনখড়

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়।
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যকার বিরোধ বেশ পুরোনো। এ বিরোধে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। এবার মমতা রাজ্যপালকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ’ বলে মন্তব্য করেছেন। বিপরীতে রাজ্যপালের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে গতকাল সোমবার মমতা রাজ্যপালের নাম উল্লেখ করে অভিযোগের তির ছোড়েন। তিনি বলেন, ‘রাজ্যপাল একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। নব্বইয়ের দশকে জৈন হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে নাম ছিল তাঁর। এমনকি ওই ঘটনায় দায়ের করা দুর্নীতি মামলার চার্জশিটে নাম ছিল ধনখড়ের। পরে পার পেয়ে যান তিনি। তবু তাঁর বিরুদ্ধে ওই ঘটনার পর একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলা এখনো চলছে।’

এ সময় মমতা প্রশ্ন রাখেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার কেন এ রকম একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে রাজ্যপাল করেছেন? আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরপর তিনবার আবেদন করেছি, তাঁকে (ধনখড়) এ পদ থেকে সরান। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাজ্যপালকে দিল্লিতে ডেকে সলাপরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার।’

মমতার এমন অভিযোগের পরেই সাংবাদিকদের কাছে নিজের অবস্থান জানান রাজ্যপাল। তিনি জানান, জৈন হাওয়ালা দুর্নীতি মামলায় চার্জশিটে তাঁর নাম নেই। মমতা মিথ্যা বলছেন। এ বিষয়ে জগদীপ ধনখড় বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। চার্জশিটে আমার নাম ছিল, এটা কেউ দেখাতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী উত্তেজনা ছড়াতে এমন অভিযোগ এনেছেন। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’

অভিযোগ মিথ্যা হলে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল বলেন, ‘মমতা সত্য থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। তাঁকে আমি ছোট বোন হিসেবে দেখি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেব না।’

নব্বইয়ের দশকে জৈন হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ভারতীয় রাজনীতিতে বেশ শোরগোল ফেলেছিল। ১৯৯১ সালে কাশ্মীরি জঙ্গি আশফাক হুসেন গ্রেপ্তার হওয়ায় জৈন হাওয়ালা কেলেঙ্কারি সামনে আসে। আশফাক হিজবুল মুজাহিদীনের সদস্য বলে তদন্তে উঠে আসে। দিল্লিতে তাঁকে জেরা করে জানা যায়, হাওড়ার ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রকুমার জৈন ও তাঁর ভাইদের মাধ্যমে ভারতের অনেক রাজনীতিক ও আমলা অর্থ পাচার করেছেন। এমনকি হিজবুলের কাছেও অর্থসাহায্য গেছে।

আশফাকের বয়ানের ওপর ভিত্তি করে সুরেন্দ্র জৈনর দপ্তর ও বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (সিবিআই)। তল্লাশিতে বিদেশি মুদ্রা, ডায়েরি উদ্ধার হয়। তাতে কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক ও আমলার নাম পাওয়া যায়। চার্জশিট দেয় সিবিআই। কিন্তু মাঝপথেই সেই তদন্ত থমকে যায়। উল্টো ওই মামলায় তদন্তকারী সিবিআই অফিসারদের এক এক করে বদলি করা হয়।

পরে জনস্বার্থ আইন মেনে সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে একটি রিট পিটিশন জমা পড়ে। তাতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে। ওই পিটিশন এখনো ঝুলে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের মতে, ডায়েরিতে নাম থাকা যথেষ্ট নয়। তবে প্রমাণের অভাবে ১৯৯৭-৯৮ সালে অনেকেই এ মামলার দায় থেকে রেহাই পান। এখন মমতার অভিযোগের মধ্য দিয়ে পুরোনো সেই বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।

২০১৯ সালের ৩০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির বিদায়ের পরে রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেন ধনখড়। তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিজেপিকে সমর্থনের অভিযোগ বেশ পুরোনো। তৃণমূল কংগ্রেস বারবার দাবি করে আসছে, রাজ্যপালের পদ নিরপেক্ষ হওয়ার পরেও ধনখড় এখনো বিজেপির হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজ্যপালের দপ্তর এখন বিজেপির রাজনৈতিক দপ্তরে রূপ নিয়েছে। বিজেপির হয়ে তিনি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রসঙ্গে প্রতিনিয়ত টুইট করছেন।

পশ্চিমবঙ্গে আসার পরপরই মমতার সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় ধনখড়ের। এবারের বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে এ বিরোধ চরম রূপ নিয়েছে। রাজ্যপালের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না রাজ্য সরকার। বেড়েছে নির্বাচনপরবর্তী সংঘর্ষ ও মৃত্যু। নিরাপত্তার অভাবে দলটির অনেক নেতা-কর্মী ঘরে ফিরতে পারছেন না। তাঁর এমন অভিযোগে ক্ষুব্ধ মমতা ও তৃণমূল নেতারা। তাঁদের মতে, ধনখড় বিজেপির উদ্দেশ্য পূরণে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন।